বিজ্ঞাপন
default-image

আইন পেশা ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমিনুল হক। তবে পেশাটা ছিল তাঁর কাছে গৌণ। রাজনীতির প্রতিই মনোযোগ ও আগ্রহ ছিল বেশি। বামপন্থী রাজনীতিতে আস্থাশীল ও ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন, দেশের মেহনতি মানুষের উন্নতি হওয়া উচিত সর্বাগ্রে।

সাংসারিক সচ্ছলতা ছিল না আমিনুল হকের। স্ত্রী তাঁকে ভবিষ্যতে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের কথা বললে তিনি বলতেন, ‘চারদিকে দেখো, অজস্র মানুষের মাথার ওপর আকাশ ছাড়া কিছুই নেই।’ আওয়ামী লীগের রাজনীতির অনুসারী না হয়েও উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমিনুল হক সপরিবার গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি ছোট ভাইয়ের খোঁজ নিতে ময়মনসিংহ শহরে আসেন। ১১ মে বিকেলের ট্রেনে গ্রামের বাড়ি ফেরার জন্য ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে যান। কিন্তু ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হয়। রাতে ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে দুজন পাকিস্তানি সেনা তাঁর বগিতে উঠে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় আমিনুল হকের স্ত্রী রওশন আরা বেগমের ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে। রওশন আরা লিখেছেন, ‘...আমি কান্নাকাটি করেও কিছুতেই তাঁকে আটকাতে পারলাম না। তিনি রওনা হলেন ময়মনসিংহের দিকে। সেদিন ছিল ২৬ এপ্রিল। হেঁটে রওনা হলেন কাছেই সুফিয়া বাজারের দিকে। ওখান থেকে রিকশা ভাড়া করে গফরগাঁও থানার শঙ্খচূঁড়া গ্রামে মামার বাড়ি হয়ে ময়মনসিংহ যাবেন। আমার চোখে এখনও তাঁর শেষ বিদায় ও শেষ যাত্রার চিত্রটি জ্বলজ্বল করে।...কেন যেন অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির সকলেই তাঁর চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তাঁর মামার বাড়িতে তাঁকে আটকে রেখে আমার দেবরকে ময়মনসিংহ পাঠিয়ে দেন একজন আত্মীয় মুসলীম লীগের প্রাক্তন এম.পি. আব্দুল হালিম মৌলভী সাহেবের সঙ্গে। কয়েকদিন পরই অস্থির হয়ে পড়েন ছোট ভাই-এর জন্য। হয়তো মৃত্যু তাঁকে টেনে আনে। মামারা জোর করেও গ্রামে আটকে রাখতে পারলেন না। ময়মনসিংহে এসে ভাইকে দেখে বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সকলেই হেঁটে বা রিকশায় যেতে বললেন। কিন্তু তাঁর হাতে বোধহয় রিকশা ভাড়া করার মতো টাকা ছিল না। আর, উনি হাঁটার কষ্টের কথা মনে করে বোধহয় ৩-৩০টার ট্রেনে গফরগাঁও হয়ে বাড়ি যেতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। ৫ম ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে ১০টা বেজে গেল। সংগে ছিলেন আমার এক মামা, উনি ঢাকা যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দুজন পাক আর্মী তাঁকে টার্গেট করে ট্রেনে উঠে সোজা উনাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আওয়ামী লীগ কর?” উনি মিথ্যা বললেন, আমি রাজনীতি করি না। “তুমি কি কর?” ওদের প্রশ্ন। “আমি উকিল” তাঁর জবাব। “উকিলরা বদমাশ, তুমি আমাদের সঙ্গে চল।” পাকবাহিনী তাঁকে ধরল। আমার মামা বললেন, “উনি শরীফ আদমী, উনার কোনো দোষ নাই।” এ কথা শুনে পাক আর্মীরা আমার স্বামীর মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে জীপে তুলে নিয়ে যায়। আমরা এ ঘটনা মামার কাছ থেকে স্বাধীনতার পরে জানতে পারি।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, ষষ্ঠ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

আমিনুল হকের জন্ম ১৯২৬ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার পোড়াবাড়িয়া গ্রামে। বাবা আবদুল কাদির ভূঁইয়া, মা খোদেজা খাতুন। ১৯৪৫ সালে হোসেনদী হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আইএ ও ১৯৪৯ সালে বিএ পাস করেন। এরপর কিছুদিন সরকারি চাকরি করেন। কিন্তু রাজনীতি করার জন্য সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করে ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহ জজকোর্টে বারে যোগ দেন।

আমিনুল হক দুই ছেলে ও চার মেয়ের জনক। ছেলে আনোয়ারুল হাসান (আইনজীবী) ও মাসুদুল হাসান (প্রবাসী)। মেয়ে ফাওজিয়া আমিন (সহযোগী অধ্যাপক), ফারাহ দীবা আমিন (গৃহিণী), ফারহানা আমিন (গৃহিণী) ও ফারজানা আমিন (চাকরিজীবী)।

ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতি ভবনের ৩ নম্বর ভবন আমিনুল হকের নামে নামাঙ্কিত। এ ছাড়া সমিতির স্মৃতিফলকেও তাঁর নাম রয়েছে।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।

[email protected]