বিজ্ঞাপন
default-image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদিম ইলেকট্রনিকস বিদ্যায় যেমন ছিলেন দক্ষ, তেমনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায়ও ছিলেন সমান পারঙ্গম।

একজনের দুই বিষয়ে পাণ্ডিত্য থাকা নিঃসন্দেহে একটি বিরাট ঘটনা। পরীক্ষণ পদার্থ ও ইলেকট্রনিকস বিদ্যায় তিনি যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন।

নিয়মনিষ্ঠ খাদিম ঘড়ি ধরে ক্লাসে আসতেন। ঠিক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ক্লাস নিতেন। নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ আর দায়িত্ববোধ ছিল তাঁর কাম্য।

অবিবাহিত আতাউর রহমান খান খাদিম থাকতেন শহীদুল্লাহ হলের (তখন ঢাকা হল) এক কক্ষবিশিষ্ট শিক্ষক বাসভবনে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে হামলা চালায়। সেই কালরাতে তিনি সেখানেই ছিলেন।

পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করে গণকবরে আরও অনেকের সঙ্গে মাটিচাপা দেয়।

সেনাদের হাতে তিনি কখন, কীভাবে শহীদ হন, সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা সম্ভব না হলেও তাঁর শিক্ষক ও পরে সহকর্মী, অধ্যাপক হিরণ্মÄয় সেনগুপ্তর একটি রচনায় সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু তথ্য রয়েছে।

তিনি লিখেছেন, ‘...কারফিউ তুলে নেওয়ার কিছু পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় আমাদের বাসায় (ফুলার রোড) ড. খালেকুজ্জামান আসেন।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকসেনাদের তাণ্ডবে কে কে বেঁচে আছেন খোঁজ নিতে এসেছেন, জীবিত আছি দেখে খুশি তিনি।...একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের যেসব নাম তিনি সংগ্রহ করতে পেরেছেন, তা বলে যেতে লাগলেন।

ড. গোবিন্দ চন্দ দেব, ড. মুনীরুজ্জামান, খান খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য...। কানে আর ঢুকছিল না।

‘শহীদ খান থাকতেন প্রথমে শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রদের নির্ধারিত কক্ষে। তিনি তখন পদার্থবিদ্যা বিভাগে একজন গবেষক-ছাত্র।

পরে তিনি চলে যান ওই হলেরই শিক্ষকদের বাসভবনে, যখন তাঁর জন্য ওখানেই বরাদ্দ করা হয় একটি কক্ষ। সেখানেই তিনি শহীদ হন ২৫ মার্চ।

গণিত বিভাগের প্রভাষক এবং শহীদুল্লাহ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক শরাফত আলীও একই সাথে বর্বরোচিত হামলার শিকার হন পাকবাহিনীর হাতে।...শহীদ খান খাদেমকে যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। মুখে স্মিত হাসি সর্বক্ষণ লেগে থাকত।

কথা বলতেন অতি সংযতভাবে, আর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার।...নিরহংকার মানুষটি—এককথায় ভালো মানুষ এবং যথার্থ ভদ্রলোক।’ (আমার সহকর্মী, স্মৃতি: ১৯৭১ , ষষ্ঠ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

আতাউর রহমান খান খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-ছাত্র হিসেবে শহীদুল্লাহ হলে থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর মোনায়েম খানের কুখ্যাত এনএসএফ ছাত্রসংগঠনের বহু কুর্কীতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি ওই পরিবেশ সম্পর্কে হিরণÄয় সেনগুপ্তকে বলতেন, ‘ I am surrounded by gangsters and murderers.’

আতাউর রহমান খান খাদিমের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার খড়মপুরে গ্রামে।

তিনি খাদিম ও খাদেম; দুই নামেই পরিচিত ছিলেন। বাবা দৌলত আহমেদ খান খাদিম ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী। মা আঞ্জুমান নেসা খাতুন।

মেধাবী ছাত্র আতাউর রহমান খান খাদিমের স্কুলজীবন কেটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে।

জর্জ এইচ ই বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক (১৯৪৮) পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে প্রথম আইএসসি (১৯৫০, প্রথম বিভাগে একাদশ) পাস করেন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। অনার্স (১৯৫৩, প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয়) ও এমএসসি (১৯৫৪, দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম) পাস করে ফিলিপস ইলেকট্রিক কোম্পানিতে এক্স-রে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।

১৯৫৯ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটে পড়ার জন্য তিনি জার্মানির গোটিংজেনে যান।

১৯৬০-এর শেষার্ধে সেখান থেকে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফেলো হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫-এর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক নিযুক্ত হন।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

<[email protected]>

সূত্র: ৩ জানুয়ারী, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত