বিজ্ঞাপন
default-image

ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরের গাঙ্গাটিয়া এলাকার জমিদার। চল্লিশের দশকে কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে তিনি চিত্রকলা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন প্রিয় শিষ্য। ভূপতি ধ্রুপদি সংগীতের সমঝদার ছিলেন, এসরাজবাদনেও ছিলেন পারদর্শী। বেশ কিছু গান রচনা করে সুরারোপও করেছিলেন তিনি।

ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গ্যালারিতে ভূপতিনাথ চক্রবর্তীর আঁকা দুটি ছবি রয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। সেনাদলপতি এক ক্যাপ্টেন তাঁর সংগীতচর্চার বিষয়টি জেনে তাঁর কাছ থেকে গান শোনে। কিন্তু বিদায় নেওয়ার সময় তারা প্রবীণ এই শিল্পীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

শহীদ ভূপতিনাথ চক্রবর্তীর বাবার নাম রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী, মা প্রাণদা সুন্দরী দেবী। তাঁর জন্ম ১৯০৮ সালে গাঙ্গাটিয়ায়। তাঁরা চার ভাই ও তিন বোন। স্ত্রীর নাম মিলন বালা দেবী। ভূপতিনাথ কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। বাড়িতে তাঁর বহু চিত্রকর্ম ছিল। একাত্তরে বাড়ি লুটপাটের সময় স্থানীয় রাজাকাররা এসব চিত্রকর্ম ধ্বংস করে ফেলে। তবে কলকাতায় ভূপতিনাথের মেয়ে বাসন্তীর বাড়িতে দুটি চিত্রকর্ম থাকায় সেগুলো রক্ষা পায়। সেই বিরল চিত্রকর্ম দুটি পরিবারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করা হয়।

শিল্প-সংস্কৃতিমনা ভূপতিনাথ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তিনি ছিলেন গোবিন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। তিনি বিনা পয়সায় হোমিও চিকিৎসাও দিতেন। তাঁর দুই ছেলে মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী ও তপন কুমার চক্রবর্তী চৌধুরী। তপন মারা গেছেন। তাঁর দুই মেয়ে জয়ন্তী ও বাসন্তী কলকাতায় থাকেন। এখন পৈতৃক জমিদারবাড়িতে বসবাস করেন মানবেন্দ্রনাথ। গত রোববার এই বাড়ির বৈঠকখানায় বসে প্রথম আলোর কাছে সেই ভয়াবহ দিনের কথা বলছিলেন মানবেন্দ্রনাথ।

মানবেন্দ্র জানান, একাত্তরের ৭ মে তাঁরা দুই ভাই ও মা বাড়িতে ছিলেন। ভূপতিনাথ পাশের গোবিন্দপুর গ্রামে সুধীরচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। খুব সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বুখারির নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন সেনা তাঁদের বাড়ি ঘেরাও করে। স্থানীয় রাজাকাররা তাঁর বাবাকে সাড়ে আটটার দিকে গোবিন্দপুর থেকে ধরে নিয়ে আসে। হানাদাররা তাঁর বাবার কাছে গান শুনতে চায়। তিনি তাদের গান শোনান। দুপুরে খাবারের ব্যবস্থাও করেন। তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন খারাপ কিছু ঘটবে না। কিন্তু বিকেল চারটায় ঘাতকের দল ফিরে যাওয়ার সময় মন্দিরের সামনে কদমগাছতলায় তাঁর বাবা ও চাচাতো ভাই পঙ্কজ কুমার চক্রবর্তী চৌধুরীসহ মোট চারজনকে হাত বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকের দল চলে গেলে সন্ধ্যার পর বাড়িতেই ভূপতিনাথকে সমাহিত করা হয়।

মানবেন্দ্রনাথ ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে পাকিস্তানি সেনাসহ স্থানীয় রাজাকারদের আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন। তবে এখন আসামি রাজাকারদের কেউ বেঁচে নেই।

গ্রন্থনা: তাফসিলুল আজিজ, কিশোরগঞ্জ।