বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় রাজশাহী শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়েছিলেন মামুন মাহমুদ। তিনি আর ফিরে আসেননি। সেদিন ছিল তাঁর বিবাহবার্ষিকী। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মামুন মাহমুদের মেয়ে যেবা মাহমুদ লিখেছেন, ‘...আমার বাবা ছিলেন রাজশাহী বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ।

একজন সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার হয়েও, তাঁর সরকারি বাসভবন ও অফিসে ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের প্রথম থেকেই কালো পতাকা নিজ হাতেই উত্তোলন করেছিলেন।

তা ছাড়া ২৫ মার্চের আগের সপ্তাহে গণ-আন্দোলনে সহায়তা করার প্রচেষ্টায় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও বাঙালি কর্মকর্তাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন কয়েকবার। কিন্তু সবকিছু গোপন থাকেনি।

২৬ মার্চ সন্ধ্যার সময় হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এসে বলে যে ডিআইজি সাহেবের সঙ্গে রংপুর থেকে ব্রিগেডিয়ার ওয়্যারলেসে কথা বলবেন।

বাবা নিজের জিপে, চালক ও দেহরক্ষীসহ চলে গেলেন। তিনি গেলেন সন্ধ্যার আধো আলো, আধো ছায়ার মধ্যে। আর ফিরে এলেন না।

যে দানবের হাত থেকে তিনি দেশকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাদের গোপন হিংসার আঘাতে কপট রাত্রির আড়ালে চিরতরে হারিয়ে গেলেন আমার বাবা।...

২৬ মার্চ ছিল আমার বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ আমাদের সবার জন্য কিছু বই কিনে এনেছিলেন। আমার জন্য ছিল কার্ল মার্ক্সের শর্ট বায়োগ্রাফিলেনিন

‘২৫ মার্চের সেই কালরাতে তিনি বই দুটিতে লাল কালি দিয়ে লিখেছিলেন, ...লেনিনের বইটিতে লেখা ছিল “যেবা, দিস ইজ অ্যাবাউট এ ডেভোটেড লিডার অব এ ভ্যালিয়ান্ট পিপল হু ওয়ানস স্ট্রাগলড ফর ইম্যানসিপেশন ফ্রম এক্সপ্লইটেশন লাইক দ্য পিপল অব বাংলাদেশ টুডে।

পাপা/আম্মা ২৬ মার্চ ১৯৭১।” (যেবা মাহমুদের রচনা। স্মৃতি ১৯৭১, প্রথম খণ্ড (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮), সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।’

কর্মজীবনে মামুন মাহমুদ কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, ফরিদপুর, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে বিভিন্ন পদে চাকরি করেন।

তিনি ছিলেন প্রগতিমনা মানুষ। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি বাঙালি স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিতেন না।

বিভিন্ন সময়ে সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করেছেন। এ কারণে পাকিস্তানিদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রাজশাহীতে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

এর প্রতিবাদে তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।

১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর, চট্টগ্রাম শহরে মামুন মাহমুদের জন্ম। বাবা ডা. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও মা শামসুন্নাহার মাহমুদ।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক পরিবেশের বেড়াজালের মধ্যে থেকেও এ দেশের যে কজন নারী সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, শামসুন্নাহার মাহমুদ তাঁদের অন্যতম।

মামুন মাহমুদ পাঁচ বছর বয়সে কবি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠির জবাবও তিনি পেয়েছিলেন।

তাঁর জন্মলগ্নে কবি নজরুল তাঁকে ‘শিশু যাদুকর’ কবিতা দিয়ে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন।

মামুন মাহমুদ ১৯৪৩ সালে কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ, ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক রিলেশনসে এমএ পাস করেন। এরপর সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ বিভাগে যোগ দেন।

মামুন মাহমুদ এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত