বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ১৩ জুন। পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের নিয়ে একটি পিকআপ ভ্যান এসে দাঁড়ায় রাঙামাটির কাপ্তাই কর্ণফুলী প্রকল্প উচ্চবিদ্যালয়–সংলগ্ন সড়কের সামনে। সঙ্গে ছিল স্থানীয় রাজাকাররা। তারা চিনিয়ে দেয় স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক বাগ্মীশ্বর বড়ুয়াকে। সেনারা তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। এরপর আর বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

শিক্ষক বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া পরিবারকে নিরাপদে রাখতে ২০ মে গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখিলে চলে যান। তিনি তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। গ্রামে গিয়ে তরুণদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার দল গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে তিনি পরিবার গ্রামে রেখে ১৩ জুন কর্মস্থল কাপ্তাই ফিরে আসেন। এ খবর পেয়েই স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তাঁকে তুলে দেয়।

বাংলা একাডেমির রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১-এর পুনর্বিন্যাসকৃত দ্বিতীয় খণ্ডে বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন স্ত্রী সবিতা বড়ুয়া। এ ছাড়া আগামী প্রকাশনীর বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থেও তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার জন্ম ১৯১৭ সালের ৩ মে। তাঁর বাল্য নাম ছিল শশাঙ্ক বিমল বড়ুয়া। বাবা রসিক চন্দ্র বড়ুয়া ছিলেন ব্যবসায়ী। বাগ্মীশ্বর ১৯৬১ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বিএড পাস করেন। পালি ভাষায় বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, এ জন্য ‘পালি সূত্র বিশারদ’ উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। বৌদ্ধ ধর্মের সার কথা নিয়ে তাঁর লেখা বিমুক্তি রূপায়ণে বৌদ্ধ ধর্ম বইটি প্রশংসিত হয়েছিল।

শহীদ বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুসারী ছিলেন। কিশোর বয়সে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে আটক করে নির্যাতন করেছিল। তিনি এবং বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো মিলে ১৯৪৯ সালে বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। চন্দ্রঘোনা নারায়ণ গিরি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, চট্টগ্রামের কাটিরহাট উচ্চবিদ্যালয়, রাঙ্গুনিয়া সরফভাটা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের স্কুল পরিদর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার স্ত্রী শিক্ষক সবিতা রানী বড়ুয়ার কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও অনুদান হিসেবে দুই হাজার টাকার চেক পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া কাপ্তাই উপজেলায় তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করে পিডিবি। তাঁর কর্মস্থল কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল ফটকে শহীদের নামের তালিকায় ২৮ নম্বরে বাগ্মীশ্বরের নাম রয়েছে।

বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার বড় মেয়ে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুভ্রা বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবার নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি তালিকায় ওঠেনি। যতবার তালিকাভুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ততবারই পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। তাঁর মা এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা গেছেন। তাঁরা পাঁচ ভাইবোন। তাঁরা এখনো প্রত্যাশা করেন, বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাবেন।

গ্রন্থনা: এস এম ইউসুফ উদ্দিন, রাউজান, চট্টগ্রাম