প্রতিদিনের মতো ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিলেও পাহাড়ি প্রকৃতির কোলে জামিজুরী গ্রামে দিনের শুরু হয়েছিল শান্ত, সুন্দরভাবে। তবে খানিক পরেই বদলে গেল অবস্থা। পাকিস্তানি হানাদার বর্বর সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার (তৎকালীন পটিয়া থানা) দোহাজারী ইউনিয়নের এই গ্রামে অতর্কিতে হামলা করে। গণহত্যা, লুণ্ঠন আর অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে পরিবেশ নরক বানিয়ে ফেলে। ঘাতকের দল হোমিও চিকিৎসক বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্যসহ ৩ জন চিকিৎসক, ২ জন শিক্ষকসহ মোট ১৩ জন নিরীহ মানুষকে সেদিন হত্যা করেছিল।
শহীদ চিকিৎসক বগলা ভট্টাচার্যের বাড়ি গিয়ে তাঁর ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুশীল কান্তি ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, পাকিস্তানি হানাদারদের হামলার সময় বাড়ি থেকে তাঁরা দৌড়ে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান। গ্রামবাসীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ায় তাঁর বাবা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর কেউ ক্ষতি করবে না—এমন বিশ্বাস থাকায় তিনি বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চাননি। তবে গণহত্যা শুরু হলে তাঁর বাবা দৌড়ে পশ্চিম জঙ্গল দিয়ে বাড়িসংলগ্ন মসজিদের মাঠ পর্যন্ত পৌঁছান। হানাদার বাহিনী তাঁকে দেখা মাত্র গুলি করে। মসজিদের মাঠে তিনি লুটিয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ মারা যান।
খুনি বাহিনী চলে যাওয়ার পর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৩ জনের লাশ স্থানীয় লোকজন বগলা ভট্টাচার্যের বাড়ির পেছনের একটি বড় গর্তে মাটিচাপা দেন। পরে একই গর্তে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বরে চন্দনাইশের হাশিমপুরে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ দুই মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ এনেও সমাহিত করা হয়।
হানাদাররা গণহত্যা শুরু করলে দোহাজারীর জামিজুরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিতেন। বগলা ভট্টাচার্যের এক ছেলেও এতে অংশ নেন। এ খবর পেয়ে হানাদাররা গ্রামে গণহত্যা চালায়।
বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২০ সালে জামিজুরী গ্রামে। তাঁর বাবা জগবন্ধু ভট্টাচার্যও ছিলেন একজন খ্যাতনামা হোমিও চিকিৎসক। মা মাধুরী লতা দেবী গৃহিণী। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শামসুল আরেফীন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে তাঁর একটি লেখায় চন্দনাইশের দোহাজারী জামিজুরী গণহত্যার বিবরণ আছে। তা ছাড়া গণহত্যায় সহযোগিতার জন্য দুজন বিহারিসহ ১৬ জন স্থানীয় রাজাকারের নামও উল্লেখ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর গ্রামের শহীদ প্রফুল্লরঞ্জন ভট্টাচার্যের ছেলে নিপু রতন ভট্টাচার্য এই গণহত্যায় সরাসরি জড়িতদের বিরুদ্ধে তৎকালীন পটিয়া থানায় একটি মামলা করেন।
বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্যের পরিবার জানায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তারা নিজেরাই তাদের জমিতে অনেক বড় এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ করে। ১৯৭৫ সালে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন জাগরণ ক্লাবের উদ্যোগে শহীদের স্মরণে এখানে জাতীয় পতাকাখচিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পরে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নতুন করে স্মৃতিসৌধ ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে। এখন এটি জামিজুরী বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। স্মৃতিসৌধে শহীদদের নাম রয়েছে।
বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্যের পরিবারের সদস্যরা জানান, চার বছর ধরে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে শহীদদের স্মরণে এখানে সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর বাবা ও অন্যরা কোনো সরকারি স্বীকৃতি পাননি। এ জন্য তাঁদের মনোবেদনা রয়েছে।
গ্রন্থনা: আবদুর রাজ্জাক, পটিয়া, চট্টগ্রাম