বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ২১ এপ্রিল, দুপুর ১২টা। পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া গাড়ি এসে থামে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া ক্যাথলিক মিশনের সামনে। ফাদার লুকাশ মারান্ডি চা-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করেন সেনাদের। তারা মিশনে তল্লাশি করে সন্দেহভাজন কাউকে না পেয়ে চলে যায়। ঘণ্টা তিনেক পর তারা আবার মিশনে এসে ফাদারকে বের করে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। অভিযোগ, ফাদার মুক্তিযোদ্ধাদের মিশনে আশ্রয় দিতেন।

ফাদার লুকাশ মারান্ডি জীবনের পুরোটা সময় মানুষের সেবা ও ধর্মীয় শিক্ষাদান করেছেন। নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার বেনীদুয়ার গ্রামের একটি মধ্যবিত্ত সাঁওতাল পরিবারে ১৯২২ সালের ৪ আগস্ট তাঁর জন্ম। বাবা মাথিয়াস মারান্ডিও ছিলেন ধর্মপ্রচারক। মা মারিয়া কিস্কু গৃহিণী।

দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। লুকাশ মারান্ডির শিক্ষাজীবন শুরু বেনীদুয়ার মিশন স্কুলে। পরে তিনি দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুল ও দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের বিহারের রাঁচি সেমিনারি ও নেল্লোর সেমিনারিতে ভর্তি হন। দর্শন শাস্ত্রে তিনি উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯৫৩ সালে যাজক পদে অভিষিক্ত হন। তাঁর কর্মজীবন শুরু মারীয়পুর ধর্মপল্লিতে। পরে তিনি দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলের ছাত্রাবাসের পরিচালক নিযুক্ত হন। এখানে তিনি সেন্ট যোসেফস সেমিনারির আধ্যাত্মিক পরিচালক এবং পরে বেনীদুয়ার মিশনে ধর্মপ্রচারকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রের শিক্ষক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শহীদ লুকাশ মারান্ডি সম্পর্কে তথ্য ও ছবি পাঠান নওগাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ। নওগাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণার ভিত্তিতে তাঁর রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ বইতে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। বাংলা একাডেমির রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি: ১৯৭১–এর পুনর্বিন্যাসকৃত চতুর্থ খণ্ডে ফাদার মারান্ডিকে নিয়ে সুনীল পেরেরার লেখা রয়েছে।

তিনি লিখেছেন, ফাদার লুকাশ সাঁওতাল ভাষায় উপাসনা ও গানের বই রচনা করেছেন। একাত্তরে তিনি ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া ক্যাথলিক মিশনে ফাদার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করলে লোকজন বাড়িঘর ফেলে পালাতে শুরু করেন। তিনি তখন রুহিয়া মিশনে হাজার হাজার শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। ফাদারের এসব কাজের কথা স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি হানাদারদের জানিয়ে দেয়।

ফাদার লুকাশ মারান্ডির ভাতিজি আননচিয়েতা মারান্ডি জানান, ঘাতক সেনারা তাঁর চাচা লুকাশ মারান্ডিকে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর লাশ উদ্ধার করে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর এলাকায় নিয়ে সমাহিত করেন।

ফাদার লুকাশ স্মরণে নওগাঁর ধামইরহাটের বেনীদুয়ার মিশনে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিফলক। এ মিশন থেকে ১৯৮৯ সালে গঠন করা হয় শহীদ ফাদার লুকাশ মারান্ডি তহবিল। এই তহবিল থেকে অসহায় ও দরিদ্রদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। দিনাজপুরে শহীদ ফাদার লুকাশ মারান্ডির নামে একটি রাস্তা ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে শহীদ ফাদার লুকাশ মারান্ডি ট্রেড স্কুল।

গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, নওগাঁ