বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ২৫ এপ্রিল সকাল নয়টা। পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের একটি দল হেঁটে ও আরেকটি দল নৌকায় করে এসে নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ছোট যমুনার তীরের আতাইকুলা গ্রামে হামলা করে। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে পুরো গ্রাম। গ্রামের সব পুরুষকে ধরে এনে গ্রামের যোগেন্দ্র নাথ পালের বাড়ির আঙিনায় লাইনে দাঁড় করায়। তাঁদের মধ্যে প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার পাল, তাঁর বাবা ও দুই ভাইও ছিলেন। ঘাতক সেনারা লাইনে দাঁড়ানো ৮০ জনকে দুই দফায় ব্রাশফায়ার করে। বাড়ির আঙিনা ভেসে যায় নিরপরাধ মানুষের রক্তস্রোতে। শহীদ হন প্রশান্ত কুমার পাল, তাঁর বাবা, দুই ভাইসহ ৫২ জন।

তরুণ প্রকৌশলী প্রশান্ত পাল এলাকার উন্নয়নে নানা ধরনের পরিকল্পনা করছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল আতাইকুলার পার্শ্ববর্তী গ্রামে চটের মিল প্রতিষ্ঠা করার। নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ছোট যমুনা নদীর তীরঘেঁষা আতাইকুলা গ্রামে জন্ম শহীদ প্রশান্ত কুমার পালের। বাবা সুরেশ্বর কুমার পাল ও মা মায়া রানী পাল। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তড়িৎ বিভাগ থেকে পাস করেন। পরের বছর থেকে রাজশাহী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কলাবাগান উপকেন্দ্রে জুনিয়র প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। প্রশান্ত পাল অবিবাহিত ছিলেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে প্রশান্ত পাল সম্পর্কে তথ্য ও ছবি পাঠান নওগাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ। নওগাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণার ভিত্তিতে প্রকাশিত তাঁর রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ ও গণহত্যা ১৯৭১ নওগাঁ বই রয়েছে। এই বইয়ে তাঁর জীবনী রয়েছে।

প্রশান্ত পালের ছোট ভাই প্রদ্যোত কুমার পাল সেই বিভীষিকাময় দিনটির স্মৃতিচারণা করে প্রথম আলোকে বলেন, হানাদার সেনারা চালাকির আশ্রয় নেয়। প্রথমে গ্রামের দুই প্রবীণ যোগেন্দ্র নাথ পাল ও লংকেশর পালকে সবার সামনে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা ঘোষণা দেয়, যারা টাকা ও মূল্যবান সম্পদ দিতে পারবে, তারা প্রাণে বেঁচে যাবে। এরপর গ্রামের নিরীহ মানুষ স্বজনদের বাঁচাতে সরল বিশ্বাসে তাঁদের মূল্যবান সম্পদ নিয়ে এসে হানাদার সেনাদের দিয়ে দেন। ঘাতকের দল সেসব সম্পদ নিয়ে দুই দফায় লাইনে দাঁড়ানো লোকদের গুলি করে। ৮০ জনের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে ২৮ জন আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। তাঁদের অনেকের শরীরে এখনো রয়েছে গুলির আঘাতের চিহ্ন। প্রদ্যোত পাল নিজেও সেই সৌভাগ্যবানদের একজন।

প্রদ্যোত পালের মতো পালপাড়ার ষাটোর্ধ্ব যোগেশ্বর পালও সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। তিনি বলেন, সেদিন হানাদার সেনারা সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত গ্রামে অবস্থান করে নারকীয় অত্যাচার চালায়। হানাদারদের একটি দল যখন গণহত্যা চালাচ্ছিল, তখন অন্য একটি দল ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন লাগানো ও লুটপাট শুরু করে। তারা গ্রামের অন্তত ২০ জন নারীকে ধর্ষণ করে।

১৯৯৮ সালে আতাইকুলা গ্রামে শহীদ ৫২ জনের গণকবর সংরক্ষণ করে তাঁদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল শহীদ পরিবারের সন্তান ও একুশে পরিষদসহ স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা গণকবরে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, নওগাঁ