বিজ্ঞাপন
default-image

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নূর আহমদ আইনজীবী হলেও খ্যাতিমান ছিলেন তাঁর দানশীলতা, বিদ্যানুরাগ ও জনহিতকর কাজের জন্য। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা তাঁর কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চেয়েছিল। তা দিতে অস্বীকার করলে একাত্তরের ২ জুন বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে।

শহীদ নূর আহমদের জন্ম ১৯২২ সালে ফটিকছড়ির নানুপুর গ্রামে। তাঁর বাবা হাফেজুর রহমানও এলাকায় সমাজসেবক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। মা সালেহা খাতুন গৃহিণী। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চবিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন নানুপুর গ্রামে। তবে পেশা হিসেবে তিনি নিয়মিত আইনচর্চা করেননি। দরিদ্র, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সহায়তাদানের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সেবা দিতেন। পাশাপাশি যুক্ত হন পারিবারিক ব্যবসায়। ওষুধ, স্টিলসহ আরও বেশ কিছু পণ্যের ব্যবসা ছিল তাঁদের। নিজের গ্রাম নানুপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাদ্রাসা। উচ্চবিদ্যালয়ের ভবনও তৈরি করে দিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি নানুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নূর আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থদানসহ নানাভাবে সহায়তা করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে বিপুলসংখ্যক মানুষ নানুপুরে আশ্রয় নেন। এসব মানুষের জন্য তাঁর উদ্যোগে নানুপুরে ‘লঙ্গরখানা’ গড়ে তোলা হয়। নূর আহমদ ও তাঁর আরেক সহযোগী মির্জা আবু আহমদ এই লঙ্গরখানা পরিচালনা করতেন। রাজাকাররা এসব কথা হানাদার সেনাদের জানিয়ে দেয়।

২ জুন ভোরে হানাদার সেনারা সারা নানুপুর ও মাইজভাণ্ডার আমতলী এলাকা ঘিরে ফেলে। হানাদার বাহিনী নূর আহমদের বাড়িতে হামলা করে তাঁর বাবা হাফেজুর রহমান ও স্ত্রী হালিমা বেগমকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় নূর আহমদ ব্যবসার কাজে শহরে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান গ্রামে। বাবা ও স্ত্রীকে ছাড়াতে যোগাযোগ করেন হানাদার সেনাদের সঙ্গে। নূর আহমদকে আটকে রেখে হানাদার বাহিনী তাঁর বাবা ও স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়।

নূর আহমদের ছেলে তৌহিদুর রহমান সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হানাদার বাহিনী আমার বাবার কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নামের তালিকা চেয়েছিল। কিন্তু বাবা নাম দিতে অস্বীকৃতি জানান। ঘাতকেরা বাবাকে গাড়িতে তুলে বিনাজুরি এলাকায় খালের ভেতর নিয়ে যায়। সেখানে প্রচণ্ড নির্যাতন করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়। পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় আমাদের বাড়িতেই লাশ দাফন করা হয়।’ দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মা হালিমা বেগমের কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকার অনুদান পাঠিয়েছিলেন। তাঁর মা ২০০৬ সালে মারা গেছেন। তাঁরা চার ভাই ও চার বোন।

নানুপুর বিনাজুরিতে শহীদ নূর আহমদের হত্যাকাণ্ডের স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে নানুপুর ইউনিয়নের সব শহীদের নাম রয়েছে। ওই তালিকায় এক নম্বরে আছে নূর আহমদের নাম।

গ্রন্থনা: সুজয় চৌধুরী, চট্টগ্রাম