বিজ্ঞাপন
default-image

খ্যাতনামা আইনজীবী এবং আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে রাজশাহীতে ব্যাপক পরিচিতি ছিল নজমুল হক সরকারের। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চারঘাট-বড়াইগ্রাম-বাগাতীপাড়া আসন থেকে এমএনএ (মেম্বার ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে সময় তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সাংগঠনিক কাজে তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। রাজশাহী মহানগরের পাড়ায় পাড়ায় সংগ্রাম কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর।

২৬ মার্চ ভোরে পাকিস্তািন সেনাবাহিনী নজমুল হক সরকারকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ শেষ রাতে সাংগঠনিক কাজ শেষে তিনি তাঁর হেতেম খাঁর বাড়িতে এসেছিলেন।

ররাতে আওয়ামী লীগ অফিস হয়ে তাঁর বন্ধু খন্দকার আলতাফ হোসেনের বাড়িতে যান। ওই বাসা থেকে বের হওয়া মাত্র তিনি পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি পড়ে যান। তখন সেনারা তাঁকে হত্যা করে।

নজমুল হক সরকারের মৃত্যু সম্পর্কে তিন রকম তথ্য পাওয়া যায়। তবে এটা নিশ্চিত, পাকিস্তানি সেনারাই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি।

এ সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী সাবেরা হকের ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘...নজমুল হক সরকারকে পাক-বাহিনী একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে তিনটি তথ্য প্রণিধানযোগ্য। এক. আওয়ামী লীগ অফিস থেকে রাত ৩টার সময় তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। দুই. অলকা হলের কাছে দৌড়ে পালাবার সময় পাক-বাহিনী তাঁকে উদ্দেশ্য করে গুলি করে। তিন. হেতেম খাঁর বাড়ি থেকে পঁচিশের রাতে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।

‘আমার স্বামী অত্যন্ত ব্যস্ততা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন অতিবাহিত করেছিলেন চব্বিশ ও পঁচিশে মার্চ।...পঁচিশ মার্চ রাত ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ অফিস থেকে হেতেম খাঁর গোপন আশ্রয়ে চলে যান। সেখান থেকে আবার রাত ৪টার দিকে আওয়ামী লীগ অফিসে আসেন। উদ্দেশ্য, গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় কাগজপত্র সরানো।...কাজটি সেরে তিনি শহরের রানী বাজারে আসেন নিজ বাড়ীর অবস্থা দেখার জন্য। দেখেন, বাড়ী বিধ্বস্ত। দরোজা জানালা ভাঙ্গা। তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে তিনি কাছেই বন্ধু খন্দকার আলতাফ হোসেনের বাড়ীতে আসেন। অবস্থা বেগতিক দেখে দু’জনই অন্যত্র পালাবার জন্য পা বাড়ালেন। কিন্তু... পাক-বাহিনী দেখে ফেলে। আলতাফ হোসেন দৌড়ে এক বাড়ীতে প্রাচীর টপকে ঢুকে পড়েন। আর আমার স্বামী অলকা হলের দিকে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করেন। তখন তাঁর হাতে জরুরী কাগজপত্রসহ একটি ব্রীফকেস। খান-সেনারা সে-মুহূর্তে পেছন থেকে তাঁকে গুলী করে হত্যা করে। তাঁর লাশ তারা নিয়ে যায়।
‘...এ সংবাদটি আমি পাই মার্চের ২৯ তারিখে।...’ (স্মৃতি: ১৯৭১, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯০, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

নজমুল হক সরকারের জন্ম রাজশাহীর বাঘা উপজেলার হরিরামপুর গ্রামে। ১৯৩২ সালের ১ জুলাই। বাবা নবিরউদ্দিন সরকার, মা মোছা. ছামিরুন।

তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি গ্রামের স্কুলে। ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৫৪ সালে আইএ ও ১৯৫৭ সালে বিকম পাস করেন। এরপর ১৯৫৯ সালে আইন বিষয়ে পাস করে ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজশাহীতে তিনি একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি পান। রাজশাহী আইনজীবী সমিতির দুবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

নজমুল হক সরকার তিন সন্তানের জনক। বড় ছেলে মো. নাসিমুল হক সরকার (ব্যবসায়ী), মেজো ছেলে নিয়াজুল হক সরকার (প্রকৌশলী ও প্রবাসী) ও ছোট ছেলে নিজামুল হক সরকার (বিদ্যুৎ প্রকৌশলী)।

স্বাধীনতার পর রাজশাহীর কাদিরগঞ্জে তাঁর নামে একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সূত্র: মো. নাসিমুল হক সরকার। প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]

সূত্র: ২২ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত