স্ত্রী-সন্তানদের সামনেই বাড়ির আঙিনায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের শিক্ষক ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকারকে।
সেদিন ছিল একাত্তরের ২১ জুন। দুর্বিষহ সেই স্মৃতিচারণা করে শহীদ ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকারের মেয়ে জনতা ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাব্যবস্থাপক মিনা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার শেষ কথাটি এখনো কানে বাজে। কাপড়ে মুখ ঢাকা রাজাকাররা পিছমোড়া করে বাবার হাত বেঁধে আঙিনায় দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়ির সবকিছু লুটপাট করছিল। মাটিতে পুঁতে রাখা গয়না আর টাকাও তারা তুলে নিয়েছিল। বাবা ওদের বললেন, “বাবারা, তোমরা আমার সবকিছু নিয়ে যাও। শুধু আমার ছেলেমেয়েদের এক বেলা খাবারের জন্য চাল আর আমার মেয়েদের জন্য একটি করে কাপড় রেখে যাও।” ওরা বাড়ির সবকিছু নিয়ে নিল। আমরা ভেবেছিলাম বাবাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু যাওয়ার সময় ওদের মধ্যে একজন আরেকজনকে ইশারায় কী যেন বলল। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি রাইফেল গর্জে উঠল, আর নিমেষে রক্তে ভিজে গেল বাবার বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তাঁর মৃতদেহ।’
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শিক্ষক ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকারে ছাত্র ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুস ছাত্তার তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও ছবি পাঠান। সেই সূত্রে তাঁর মেয়ের সঙ্গে কথা হয়। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি: ১৯৭১-এর পুনর্বিন্যাসকৃত তৃতীয় খণ্ডে বাবাকে নিয়ে তাঁর একটি লেখা রয়েছে।
ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার ছিলেন ঈশ্বরগঞ্জের বিশ্বেশ্বরী উচ্চবিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক। এত ভালো অঙ্ক জানতেন যে এলাকায় ‘অঙ্কের জাহাজ’ নামে খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। ইংরেজিও খুব ভালো জানতেন। দুর্বল ছাত্রদের তিনি দরকার হলে তাদের বাড়িতে গিয়ে আলাদা করে পড়াতেন এবং সে জন্য কোনো অর্থ নিতেন না। এ ছাড়া তারাকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বর্তমানে সরকারি) প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের ৫১ শতাংশ জমি দান করেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় সোহাগী ইউনিয়নের বড় তারাকান্দি গ্রামে। তাঁর বাবা পার্বতীচরণ সরকার ছিলেন ব্যবসায়ী, মা মানদা সুন্দরী দেবী গৃহিণী।
ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সাধারণ গণিত ও অতিরিক্ত গণিতে ৯৯ নম্বর নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেন। কলকাতা হাইকোর্ট থেকে লিগ্যাল এডুকেশন পরীক্ষায় ফোর্ট উইলিয়াম হাইকোর্টের অধীনে মোক্তার পাস করে আইন পেশায় যুক্ত হন ধীরেন্দ্র চন্দ্র। আইনজীবী হিসেবে সফল হলেও পেশাটি তাঁর পছন্দের ছিল না। এলাকার মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে আইন পেশা, পৈতৃক ব্যবসা সব ছেড়ে তুলনামূলক অল্প আয়ের শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে এলাকাবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় অনেক যুবক ও তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এ কারণে রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ২১ জুন গভীর রাতে একদল রাজাকার এই নির্লোভ শিক্ষকের বাড়িতে হামলা করে তাঁকে হত্যা করে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না রানী সরকারকে একটি শোকবার্তা ও দুই হাজার টাকার অনুদান পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তরফে শহীদ ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকারের স্মরণে শ্মশানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি স্বীকৃতি তিনি পাননি।
গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান, ঢাকা