সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন চিকিৎসক সেনা কর্মকর্তা এ এফ জীয়াউর রহমান (আবুল ফজল জীয়াউর রহমান)।
সিলেট মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
একাত্তরের ১৫ মার্চ থেকে সিলেটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা জীয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে।
১৪ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। কোথাও তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ সম্পর্কে জানা যায় জীয়াউর রহমানের মা মাসুমা চৌধুরীর রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানিরা জীয়ার দেশপ্রেমের প্রতিশোধ নিতে শুরু করলো; ১৫ মার্চ থেকে তাঁকে স্বগৃহে অন্তরীণ করে রাখে।
বাইরের সাথে যোগাযোগের অভাবে ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দিলো। জীয়াউর রহমানের সহকর্মী ডা. শামসুদ্দীন আহমেদকে সিলেট হাসপাতালে প্রকাশ্যে গুলি করে পাকিস্তানিরা হত্যা করে।
জীয়া বুঝতে পারলো পরবর্তী লক্ষ্য সে। আর্মির কমান্ডার তখনও তাঁকে ইসলামাদ গিয়ে কাজে যোগদানের জন্য অনুরোধ করছিল। কিন্তু পর্বতের মতো অটল মনোভাব নিয়ে সে দেশের প্রতি চেয়ে রইলো।...
ক্ষতবিক্ষত দেশ, কানে কামান ও বন্দুকের শব্দ, পেটে ক্ষুধার জ্বালা। কিন্তু সে প্রলোভনের কাছে কিছুতেই নতি স্বীকার করলো না।
‘...সম্পূর্ণ জনহীন দ্বিতল বাড়িতে বদ্ধ পরিবেশে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজন ও দুটি শিশু। কিন্তু তাদের আহার কোথায়?
কয়েক দিন প্রায় অনাহারে থেকে ১৪ এপ্রিল সকালে স্ত্রীকে বললো, বড় ক্ষুধা পেয়েছে, একটু ভালো নাশতা তৈরি করতে পারবে?
গত সন্ধ্যায় এক বিহারি ডাক্তার গৃহিণী কিছু চাল, ডাল, ময়দা ইত্যাদি দিয়ে গিয়েছিল। এটাই তাঁর শেষ নাশতা খাওয়ার ইচ্ছা, সেই ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য স্ত্রী ফেরদৌসী স্বামীর জন্য আহার্য তৈরির শেষ সুযোগ আল্লাহ ডাক্তার গৃহিণীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে নাশতা আর খাওয়া হয়নি।
গোসল শেষ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে খাবার ঘরে প্রবেশ করার সময় তাঁর বাসভবনের সামনে এক ট্রাক বোঝাই রাইফেলধারী পাকিস্তানি আর্মি ও জিপ এসে দাঁড়ালো, একজন লেফটেন্যান্ট সামনে এসে স্যালুট করে অ্যাটেনশন নিয়ে দাঁড়ালো এবং বললো, ইন্টারোগেশনের জন্য নিয়ে যেতে এসেছি।
জীয়া সন্তানদের হাত ছেড়ে দিলো। চুমু খেয়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তে স্ত্রীর দিকে ফিরে চাইলো, হাত উঠিয়ে বিদায় নিয়ে চোখের অশ্রুকে গোপন করার জন্য দ্রুত প্রস্থান করলো।
ফেরদৌসীর হাত হতে জীয়ার ক্ষুধার আহার্য ভর্তি থালা সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। টেবিলে খাবার উন্মুক্ত পড়ে রইলো, ফেরদৌসীর পাশে তখন অবুঝ দুটি শিশুসন্তান।
তারপর ফেরদৌসী আশায় আশায় প্রহর গুনেছে, নিরাশায় হাতছানি দিয়ে গত হয়েছে তার কত দিন কত বছর।’ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, প্রথম প্রকাশ ২০০৯। সম্পাদনা বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ)।
এ এফ জীয়াউর রহমানের জন্ম ১৯২৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার নওগাঁ গ্রামে। বাবা মোসলেহউদ্দিন ভূঁইয়া।
তিনি ব্রিটিশ আমলে কয়েক বছর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। শৈশবেই পিতৃহারা হয়েছিলেন জীয়াউর রহমান।
তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি গ্রামের স্কুলে। স্থানীয় স্কুল ও কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।
এমবিএএস পাস করে ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন।
১৯৬৮ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষ ও সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন।
গ্রাম ছিল তাঁর প্রিয়। গ্রামের শ্যামল দৃশ্য ও স্নিগ্ধ ছায়া তাঁকে কর্মজীবনেও আকর্ষণ করত। মাঝে মাঝেই তিনি নিজ গ্রামে চলে আসতেন।
পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী ও সোচ্চার। যার অনিবার্য পরিণতিই অকালমৃত্যু।
জীয়াউর রহমান দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে শাদ বিন জীয়া (কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও কানাডাপ্রবাসী) ও খালেদ বিন জীয়া। মেয়ে শাহরীন রহমান। স্ত্রী ফেরদৌসী চৌধুরী।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
সূত্র: ১৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত