বিজ্ঞাপন
default-image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন ন আ ম ফয়জুল মহী। খেলাধুলা ও শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ।

প্রিয় ছিলেন শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের কাছেও। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসরেরা তাঁকে তাঁর ফুলার রোডের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর তাঁর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

ন আ ম ফয়জুল মহী সম্পর্কে জানা যায় তাঁর সহকর্মী ম ওবায়দুর রহমানের ‘আমার সহকর্মী’ রচনা থেকে।

তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পুরো সময়টাই ছিল সকলের জন্য উৎকণ্ঠা ও ভয়ের।

ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। শিক্ষা গবেষণা ইনিস্টিটিউটের পরিবেশ ও এখানে অবস্থান ক্রমে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠতে লাগল।

সে-সময় এখানে বেশ কয়েকজন অবাঙ্গালি শিক্ষক-শিক্ষিকা, অফিসার ও কর্মচারী ছিলেন। মাঝে মধ্যে পাকিস্তানি আর্মির লোকজন, সাদা পোষাকে গুপ্তচর এবং অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা ছিল।...

সে সঙ্গে ছিল পাকিস্তানিদের কিছু দালাল, বিশেষ করে শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ড. মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহর সন্দেহজনক কার্যাবলী।

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তীব্র, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ও কটূক্তি যা অনেক সময় সহ্যের সীমা ছেড়ে যেত।...

এমনও শোনা যায় ড. হাবিবুল্লাহ সে-সময় ঢাকাস্থ আলবদর বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন।...
‘১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কথাবার্তা সব ঠিকঠাক, ১১ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে সকলে জিঞ্জিরা ঘাটে মিলিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে চলে যাব।...

ড. মহীকে সময়মতো প্রস্তুত হয়ে বের হওয়ার জন্য সংবাদ দিতে সেদিন সকাল ৭টায় তার ফুলার রোডের ৩৫ নং বাসায় গেলাম।...

উনিও আমার অপেক্ষায় ছিলেন। আমাকে দেখে নেমে এলেন। তখনও প্রস্তুত হননি দেখে মনে সংশয় জাগল।

হতাশভাবে জানালেন, রাত্রে দেশ থেকে কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন, এ মুহূর্তে তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।...

‘তারপর এল সেই ১৬ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক বিজয় দিবস। আমরা যে দল যে দিকে ঢাকা ছেড়েছিলাম, খুশিমনেই ফিরে এলাম। এসেই শুনলাম ড. মহী নেই, নেই আরও অনেকে।

ড. মহী সম্বন্ধে যা শুনলাম—১৪ ডিসেম্বর সকালে সাদা এক মাইক্রোবাস এসে ফুলার রোডের ৩৫ নং বাসার কাছে থামে।

ড. আবুল খায়ের বাসার সামনেই একটা শাল গায়ে দিয়ে ঘোরা-ফেরা করছিলেন। মাইক্রোবাস থেকে ৭/৮ জন মুখোশধারী যুবক, ১৮/১৯ বছর হবে, হাতে স্টেনগান, রাইফেল নিয়ে নেমে আসে।

প্রথমেই ড. খায়েরকে ধরে এবং ঐ বিল্ডিং-এর তিন তলা থেকে, লুঙ্গীপরা, চোখ বাঁধা অবস্থায় ড. ফয়জুল মহীকে ধরে নিয়ে এসে মাইক্রোবাসে উঠায়।

ঠিক ঐ সময় ড. হাবিবুল্লাহ কাছেই ৩৬ নং বিল্ডিং-এর বারান্দা থেকে সব কিছু দেখছিলেন। তিনি ওখান থেকেই জানিয়ে দেন সঠিক লোকদেরই ধরা হয়েছে।

এই তাঁদের শেষ যাওয়া। স্বাধীনতার পরে কুখ্যাত রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে শত শত শহীদের মধ্যে ড. মহীর গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত, বিকৃত লাশ সনাক্ত করা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের উত্তর পাশে অন্যান্য শহীদদের সাথে সমাহিত করা হয়।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, ষষ্ঠ খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯৩, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

ন আ ম ফয়জুল মহীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ১০ আগস্ট ফেনীতে। ফেনীর সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৫৫), ফেনী কলেজ থেকে আইএ (১৯৫৭) ও বিএ (১৯৫৯) পাস করেন।

১৯৬২ সালে ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএড পাস করেন। দুই বছর ফেনীর জিএম একাডেমিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করার পর আইইআরে এএমএড কোর্সে ভর্তি হন।

শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী ও পরিশ্রমী। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডোয় ভর্তি হন।

তিন বছরের মধ্যে এমএ ও পিএইচডি করে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষক হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ৯ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত