বিজ্ঞাপন
default-image

রাজনীতিসচেতন জয়নাল আবেদিন পেশায় ছিলেন শিক্ষক। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে নওগাঁর ধামইরহাট এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদাররা গণহত্যা শুরু করলে এলাকার তরুণ ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। এ জন্য তিনি হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের বিরাগভাজন হন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল একাত্তরের ১৮ মে বেলা ১১টার দিকে ধামইরহাট উপজেলার দেউলবাড়ি গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা দেউলবাড়ি গ্রামে শিক্ষক জয়নাল আবেদিনের বাড়ি চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে সদর দরজা ভেঙে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঘাতক সেনাদের গ্রামে আসার খবর পেয়ে জয়নাল আবেদিন সপরিবার আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁকে খুঁজে না পেয়ে হানাদার সেনারা গ্রামের কয়েকজন নারী ও শিশুকে ধরে নিয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে নিরীহ ওই নারী ও শিশুকে বাঁচাতে জয়নাল আবেদিন বেরিয়ে এসে হানাদার সেনাদের কাছে ধরা দেন। ঘাতকের দল তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। পরে তাঁকে ধামইরহাট ফার্সিপাড়ায় ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শিক্ষক জয়নাল আবেদিন সম্পর্কে ছবি ও তথ্য পাঠান নওগাঁর সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাবেক সাধারণ সম্পাদক তরুণ গবেষক মোস্তফা আল মেহমুদ। একাত্তরে নওগাঁর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণা গ্রন্থ রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁতে শহীদ জয়নাল আবেদিনের জীবনী ও মুক্তিসংগ্রামে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই সূত্রে অনুসন্ধান করা হয়।

শহীদ জয়নাল আবেদিনের জন্ম ১৯১৮ সালে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার দেউলবাড়ি গ্রামে। বাবা মধু মণ্ডল ও মা জমিরন বিবি। ১৯৩৪ সালে ধামইরহাট ফার্সিপাড়া হাই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে ১৯৪৫ সালে চক ইসমাইল কে এফ জুনিয়র মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এখানেই শিক্ষকতা করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগম গত বছর মারা গেছেন।

একাত্তরে ঘাতকদের হাতে বাবার শহীদ হওয়ার সময় মাতৃগর্ভে ছিলেন জয়নাল আবেদিনের ছোট ছেলে মতিউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা ও অন্য স্বজনদের কাছ থেকে শুনেছি, একাত্তরের ১৮ মে বাবা নারী ও শিশুদের বাঁচাতে আত্মগোপন থেকে বের হয়ে এলে আমাদের বাড়িতেই তাঁকে হানাদার সেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে নির্যাতন করে। পরে আহত অবস্থায় আটকে রাখা হয় স্থানীয় রাজাকার আফতাব সরকারের বাড়িতে। সেখান থেকে ওই দিন সন্ধ্যায় বাবাকে ধামইরহাটের ফার্সিপাড়া সেনাক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে সেখানেই গণকবর দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর আমার ভাই ও চাচারা বাবার দেহাবশেষ তুলে এনে বাড়ির পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন।’

জয়নাল আবেদিনের নাতি ইশতিয়াক হাসান স্থানীয় কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি জানান, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ পরিবার হিসেবে সমবেদনা জানিয়ে তাঁর দাদিকে চিঠি ও দুই হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের আক্ষেপ, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দাদার শহীদ হওয়ার সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি।

গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, নওগাঁ