বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের আজকের এই দিন ১৪ অক্টোবরে পাকিস্তানি হানাদার বর্বর সেনারা নওগাঁর বদলগাছি ইউনিয়নের গয়েশপুর গ্রামে চালিয়েছিল নারকীয় গণহত্যা। তাতে তরুণ নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা ছামসুল হক চৌধুরী, ছোট ভাই আইনজীবী আবু ফারুক চৌধুরীসহ ১৫ জন নিরপরাধ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন।

তখনো ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। একদল পাকিস্তানি ঘাতক সেনা গয়েশপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা পুরো গ্রাম ঘিরে গোলাগুলি শুরু করে। গোলাগুলির শব্দে জেগে ওঠে গ্রামবাসী। আর্তচিৎকার ও প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটিতে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। ঘাতক সেনারা তাদের কাছে থাকা নামের তালিকা ধরে ধরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সেই তালিকায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার নাট্যকার ছামসুল হক চৌধুরী ও ছোট ভাই আইনজীবী আবু ফারুক চৌধুরীর নাম।

শহীদ ছামসুল হক চৌধুরী ছিলেন গয়েশপুর থিয়েটার গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য। তাঁর নির্দেশিত কয়েকটি নাটক শাহজাহান, সিরাজউদ্দৌলা, কালিন্দির চর, দায়ী কে ইত্যাদি। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই দেশকে হানাদারমুক্ত করতে এলাকার তরুণ ও যুবকদের সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে ছামসুল হক চৌধুরীর ছবি ও বিস্তারিত তথ্য পাঠান নওগাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ রাসেল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাঁর মাঠপর্যায়ের গবেষণাগ্রন্থে (রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ) শহীদ ছামসুল হক চৌধুরী সম্পর্কে তথ্য রয়েছে।

ছামসুল হক চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালে, ছোট যমুনা নদীর তীরঘেঁষা বদলগাছি উপজেলার গয়েশপুর গ্রামে। বাবা ওয়ারেছ আলী চৌধুরী ও মা শরিফুন নেছা। তিন ভাইয়ের মধ্যে ছামসুল হক চৌধুরী বড়। ছোটবেলা থেকে অভিনয়ের প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল তাঁর।

ছামসুল হক চৌধুরীর মেজ ভাই ছয়ফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্যার কারণে ছয়-সাত মাস গয়েশপুর গ্রামের সঙ্গে অন্যান্য গ্রামের স্থল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। দুর্গম যোগাযোগের কারণে যুদ্ধের সময় তাঁদের গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে এসে প্রতি রাতে তাঁদের গ্রামে আশ্রয় নিতেন। বড় ভাই ছামসুল হক চৌধুরী ও ছোট ভাই আবু ফারুক চৌধুরীর নেতৃত্বে গ্রামের মুক্তিকামী মানুষ চাঁদা তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতেন। একপর্যায়ে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গ্রামটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়ার খবর দেয়। একাত্তরের ১৪ অক্টোবর ভোরবেলা গয়েশপুর গ্রামে হানা দিয়ে তালিকা ধরে ধরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে বর্বরের দল।

ছয়ফুল হক বলেন, ‘সেদিন আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু বড় ভাই ও ছোট ভাই পালাতে পারেননি। তাঁরা বাড়িতেই একটি কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন। হানাদার সেনাদের সঙ্গে আসা স্থানীয় রাজাকার বাজু চৌধুরী ও তার ছেলে আলো চৌধুরী আমাদের বাড়ির দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে তাদের খুঁজে বের করে। বাড়িতেই সবার সামনে দুই ভাইকে তারা গুলি করে হত্যা করে।’

নাট্যজন শহীদ ছামসুল হক চৌধুরীর কথা স্মরণে রেখেছেন এলাকাবাসী। গয়েশপুর থিয়েটার হলের সামনে নির্মিত শহীদ স্মৃতি ফলকে ছামসুল হক চৌধুরীর নাম রয়েছে। একুশে পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতিবছর এখানে শহীদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার এখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে না। ঘরোয়াভাবে নওগাঁয় একুশে পরিষদের কার্যালয়ে আজ সন্ধ্যায় গয়েশপুর গণহত্যা নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, নওগাঁ