দৈনিক আজাদ পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ছিলেন চিশতি শাহ হেলালুর রহমান। থাকতেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (তখন ইকবাল হল)।
ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। হল ছাত্র সংসদের পাঠাগার সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
সেদিনের ঘটনা ও চিশতি শাহ হেলালুর রহমান সম্পর্কে জানা যায় তাঁর সহপাঠী ও বাংলা একাডেমির সাবেক কর্মকর্তা মফিজুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু’ রচনা থেকে।
তিনি লিখেছেন, ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের দু’শো বারো নম্বর কক্ষটি অনেক স্মৃতিতে বিজড়িত। কে জানতো, হলের দারোয়ান শামসু, স্টুয়ার্ড জলিল, ছাত্র কালাম, মনির, তাহের, জাফর আলম, কাইয়ুমের সঙ্গে ওই কক্ষটির অতি পরিচিত সংগ্রামী, নিবেদিত প্রাণ সাংবাদিক বন্ধুটিকেও আমরা হারিয়ে ফেলবো।...
‘সাবেক ইকবাল হলে মার্চের ৫ তারিখে চিশতী প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে সালাম জানায় ও শপথ গ্রহণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার।
তার সাথে ছিলেন হল সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি জনাব জিন্নাত আলী, ছাত্রলীগের হল শাখার দপ্তর সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ও আমি।
‘...হলের পাশের দোকানদার খালেক চিশতীর মৃত্যু সম্বন্ধে আমাকে বলেছিল।
‘পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী যখন ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে তখন চিশতী দোতলায় ওর জানালার পাশের হল আর অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি শেডটির ওপর লাফিয়ে পড়ে।
সারাটা রাত ওই শেডের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকে চিশতী। জীবনমৃত্যুর লড়াই হলো সারারাত।
‘পূর্বের আকাশ ফরসা হয়ে গেছে। সারারাত গুলিবর্ষণের পর পাকিস্তানী হায়েনাদের যন্ত্রগুলো তখন নিশ্চুপ। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে, চিশতী হয়তো তাই ভেবেছিলো।
‘হানাদার বাহিনীর কেউ কোথাও আছে কিনা দেখার জন্য চিশতী যখন মাথাটা সামান্য উঁচু করলো, ঠিক তখনই খালেকের দোকানের সামনে পাহারারত হানাদার কুকুরটা তেড়ে এলো।
‘নুরু নামের এক রিক্সাওয়ালাকে লাশ কুড়িয়ে এক জায়গায় জমা করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছিল।
চিশতী শেডের ওপর থেকে লাফ দিতে চাইলে ও বাধা দিয়ে বললো, “পাইপ বেয়ে নেমে আসুন স্যার, লাফ দিবেন না।”
হলের সামনে পুকুরের পাশে মেজর। তার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো চিশতীকে।
‘দৈনিক আজাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে নিজের পরিচয় পেশ করলো চিশতী। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
হলের পেছনদিক থেকে ডাইনিং হলের দিকে যেতে যে সরু রাস্তাটা—তারই পাশে ড্রেনের কাছে গাছটির নীচে দাঁড় করিয়ে পর পর তিনটি গুলি করা হলো চিশতীকে।...প্রথম গুলিটি যখন ওর বুকের বামপাশ ভেদ করে বেরিয়ে গেল, তখনই তিনি “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
‘চিশতী কি কোন বধ্যভূমিতে পচে গলে মাটির সাথে গিয়েছিল, নাকি বর্বর বাহিনী পেট্রোল দিয়ে তার দেহটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তা আমরা কেউ জানতে পারিনি।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯০, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
চিশতি শাহ হেলালুর রহমানের জন্ম ১৯৪৭ সালে, বগুড়ায়। পৈতৃক বর্তমান স্থায়ী নিবাস বগুড়া শহরের রহমান নগর।
বাবা চিশতী মনসুর রহমান, মা সাজেদা খাতুন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৬৭ সালে আইএ পাস করেন।
১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে বিএ (অনার্স) পাস করে এমএ ভর্তি হন।
১৯৭০-৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের সময় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা পতাকা দিবসে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্যারেডে নেতৃত্ব দেন তিনি।
চিশতি শাহ হেলালুর রহমান অবিবাহিত ছিলেন।
সূত্র: চিশতি রেজাউর রহমান (চিশতি শাহ হেলালুর রহমানের ভাই)। প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (নবম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (২০০০) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]
সূত্র: ২৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত