বিজ্ঞাপন
default-image

নওগাঁর বলিহার বাজারের চালাঘরে ওস্তাদ মানিক কিশোর নান্যাসী গানের আসর বসিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে’। একাত্তরে তিনি গানে গানে তরুণদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেন। পাকিস্তানি হানাদার সৈনিক আর তাদের দোসর রাজাকাররা বলিহার বাজারের ওই চালাঘরেই হাত-পা বেঁধে গায়ে পেট্রল ঢেলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে তাঁকে। এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছিল একাত্তরের ৬ মে।

নওগাঁর সুরসম্রাটখ্যাত এই শহীদ সংগীতজ্ঞকে সেখানকার মানুষ এখনো ভোলেননি। গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এই শহীদ পরিবারের সদস্য ও একুশে পরিষদ, নওগাঁর সদস্যরা।

শহীদ মানিক কিশোর নান্যাসীর জন্ম নওগাঁর বলিহার জমিদার পরিবারে ১৩১৬ বঙ্গাব্দে। তাঁর বাবা ঈশ্বর আনন্দ, মা হেম লতা। ১৩৩২ সনে মানিক কিশোর কলকাতায় গিয়ে মহারানি হেমন্তকুমারীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর তিনি তৎকালীন বিখ্যাত সংগীতসাধক গিরিজাকান্ত চক্রবর্তীর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। ১৩৩৬ সনে তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৩৩৯ সালে মানিক কিশোর লক্ষ্ণৌর মরিস মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চাঙ্গসংগীতের উচ্চতর সনদ লাভ করেন। পরে তিনি বাংলা সংগীতে মনোনিবেশ করেন এবং রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, ইসলামি গজল, শ্যামাসংগীত, রামপ্রসাদ, অতুল প্রসাদদের গানের চর্চা করেন। কণ্ঠসংগীত ছাড়াও মানিক কিশোর সেতার, এসরাজ, তানপুরা, হারমোনিয়াম ও তবলাবাদনে পারদর্শী ছিলেন। সংগীতশিক্ষা শেষে ১৩৪৭ সনে তিনি নিজ ভূমি বলিহারে ফিরে এসে উৎসাহী তরুণ প্রজন্মকে গান শেখানোর কাজ শুরু করেন। মানিক কিশোর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন নওগাঁর সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ রাসেল। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপে প্রথম আলো। সেই বিজ্ঞাপন দেখে মোস্তফা-আল-মেহমুদ মানিক কিশোর নান্যাসীর ছবি ও জীবনপঞ্জি পাঠিয়েছেন।

মানিক কিশোর সম্পর্কে ‘আমার প্রিয়জন’ নামে নওগাঁর সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এ বি এম রফিকুল ইসলামের একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা রয়েছে রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমির স্মৃতি: ১৯৭১-এর পুনর্বিন্যাসকৃত চতুর্থ খণ্ডে। তিনি লিখেছেন, হিন্দুপ্রধান বলিহার গ্রামের দুই দিক থেকে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা আক্রমণ চালায়। তাদের সঙ্গে ছিল রাজাকার, বিহারি ও শান্তি কমিটির লোকেরা। প্রায় দুই শ বাড়িতে তারা আগুন জ্বালিয়ে দেয়। লুটপাট ও গণহত্যা চালায়। ‘ওস্তাদ মানিক কিশোর নান্যাসী বাড়ির পশ্চিম দিকে তাওয়ালের বিলের এক গর্তে লুকিয়ে ছিলেন, পাকিস্তানি হানাদারেরা টের পেয়ে সেখান থেকে তাঁকে ধরে এনে বেদম মারধর করে, অতঃপর বলিহার বাজারের সামনে চালাঘরে হাত-পা বেঁধে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারে। তাঁর সৎকারে কেউ এগিয়ে আসেনি।’

প্রথম আলোর নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, মানিক কিশোরের স্ত্রী বাণীবালা দেব্যা ১৯৯৬ সালে এবং বড় ছেলে শ্যামল কিশোর নান্যাসী ২০০৮ সালে মারা যান। ছোট ছেলে কমলেন্দ্র নান্যাসী পোস্টমাস্টার ছিলেন, এখন অবসরে।

গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান, ঢাকা।