বিজ্ঞাপন
default-image

নজরুলসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীতে নওগাঁ অঞ্চলে সুনাম কুড়িয়েছিলেন শিল্পী উত্তম কুমার পাল। এ ছাড়া সেতার, হারমোনিয়াম, তবলাবাদনেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। উত্তম পালের জীবন কাটত সংগীতচর্চার ভেতর দিয়েই। একাত্তরের ২৫ এপ্রিল হামলা চালিয়ে উত্তমসহ আতাইকুলা গ্রামের ৫২ জনকে গুলি করে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদল।

নওগাঁর রানীনগরের ছোট যমুনা নদীর তীরঘেঁষা আতাইকুলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে উত্তম পালের জন্ম। বাবা নগেন্দ্র নাথ পাল ও মা শান্তিলতা পাল। পড়াশোনা করেছেন কাশিমপুর স্কুল ও রানীনগর পাইলট হাইস্কুলে। মায়ের কাছেই তাঁর সংগীতের হাতেখড়ি। মৃত্যুর আগে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। সংগীতচর্চা ছাড়াও এলাকার যাত্রা দলে অভিনয় করতেন উত্তম।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শহীদ উত্তম পাল সম্পর্কে তথ্য ও ছবি পাঠান নওগাঁর সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ। নওগাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণার ভিত্তিতে প্রকাশিত তাঁর রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ বইয়ে উত্তম পালের জীবনী রয়েছে। তাঁর দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

একাত্তরের ২৫ এপ্রিল উত্তমসহ আতাইকুলা গ্রামে ৫২ জন নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন প্রদ্যোত কুমার পাল। সেই বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, সেদিন সকাল নয়টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের একটি দল নওগাঁ থেকে আতাইকুলা গ্রামে ঢোকে। প্রায় একই সময়ে আরেকটি দল নৌকা দিয়ে ছোট যমুনা নদীপথে পূর্ব দিক দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। তারা চারদিক থেকে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। গ্রামের সব পুরুষ ধরে এনে উত্তম পালের জেঠা যোগেন্দ্র নাথ পালের বাড়ির বড় আঙিনায় লাইনে দাঁড় করায়। মোট ৮০ জন গ্রামবাসীকে তারা ধরে আনে। তাঁদের মধ্যে উত্তম, তাঁর বাবা, জেঠা, কাকা ও কাকাতো ভাইয়েরাও ছিলেন। দুপুরের দিকে ঘাতক সেনারা দুই দফায় লাইনে দাঁড়ানো এই ৮০ জনকে গুলি করে। বাড়ির আঙিনা ভেসে যায় রক্তস্রোতে। সৌভাগ্যক্রমে এই ৮০ জনের মধ্যে ২৮ জন প্রাণে বেঁচে যান। তবে তাঁদের অনেকের শরীরে এখনো রয়েছে গুলির আঘাতের চিহ্ন। প্রদ্যোত কুমার পালও সৌভাগ্যবানদের একজন। এই গণহত্যার পরদিন ২৬ এপ্রিল প্রদ্যোত পাল ও তাঁর ভাই ভবেশ্বর পাল গ্রামের আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় যোগেন্দ্র নাথ পালের বাড়ির পশ্চিম দিকে একটি গর্ত খুঁড়ে ওই ৫২ জন শহীদকে গণকবর দেন।

স্ত্রী অর্পণা পাল, ছেলে তাপস পাল ও মেয়ে পপি পালকে রেখে শহীদ হন উত্তম পাল। অর্পণা পাল ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

ছেলে তাপস কুমার পাল বলেন, ‘একাত্তর সালে আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। শুনেছি বাবা পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আহত হওয়ার পরও প্রায় ৬ ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন। ভয়ে কেউ তাঁকে বাঁচাতে যেতে পারেনি। বাবা যে দিন মারা যান, তার কয়েক দিন পরেই রাজশাহী বেতারে বাবার গান রেকর্ডিং হওয়ার কথা ছিল।’

আতাইকুলা গ্রামের ৫২ শহীদের কথা মনে রেখেছেন এলাকাবাসী। সরকারি উদ্যোগে আতাইকুলা গণকবরে রানীনগর উপজেলা প্রশাসন ও শহীদ পরিবারের সন্তানদের উদ্যোগে শহীদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিবছরের ২৫ এপ্রিল সেই গণকবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শহীদ পরিবারের সন্তানসহ স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা।

গ্রন্থনা : ওমর ফারুক, নওগাঁ