বিজ্ঞাপন
default-image

‘পালাবে ওরা (পাকিস্তানি), এ দেশ তো আমাদের। আমরা চোরের মতো পালাব কেন?’ একাত্তরের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মা বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইলে বাবা এ কথা বলেছিলেন। কিন্তু জীবন দিয়ে দেশকে ভালোবাসার চরম মূল্য দিতে হয়েছিল বাবাকে। কথাগুলো বলছিলেন শহীদ আয়েজ উদ্দিনের মেয়ে আসমা আলী।

সৈয়দপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠক আয়েজ উদ্দিনকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। একাত্তরের ১২ এপ্রিল নির্মম নির্যাতনে হত্যা করে তাঁকে। বিহারি (অবাঙালি) অধ্যুষিত সৈয়দপুরে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, আয়েজ উদ্দিন তাঁদের অন্যতম।

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা আসমা আলী তাঁর বাবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, সৈয়দপুর শহরের উপকণ্ঠে সেনানিবাস এলাকায় তাঁদের বাড়ি। পেশাগতভাবে তাঁর বাবা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। তবে তিনি দাপ্তরিক কাজের বাইরে সৈয়দপুরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই মেতে থাকতেন। ‘গীতাঞ্জলি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিবছর গীতাঞ্জলির উদ্যোগে মঞ্চ করে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী, বাংলা নববর্ষ বরণসহ ঋতুভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন। এসব অনুষ্ঠানে কোনো উর্দু গান পরিবেশন করা হতো না।

সরকারি চাকরির কারণে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নিলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন আয়েজ উদ্দিন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় তিনি বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শহীদ চিকিৎসক জিকরুল হকের সঙ্গে তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। একাত্তরের ২৩ মার্চ তিনি বাড়ির ছাদে মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলের একটি স্মরণিকায় শহীদ আয়েজ উদ্দিনের জীবনী রয়েছে। কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদা গ্রামে ১৯২০ সালে তাঁর জন্ম। তাঁর আট সন্তান। স্ত্রী সাফিয়া বেগম ২০১৭ সালে মারা যান।

একাত্তরের ৩০ মার্চ সারা রাত সৈয়দপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের গোলাগুলি চলে। অনেক বাঙালি সেনা শহীদ হন। পরদিন সকাল থেকেই আয়েজ উদ্দিনের পরিবারকে পাকিস্তানি সেনারা গৃহবন্দী করে রাখে। বেলা তিনটার দিকে তারা আয়েজ উদ্দিনকে মিলিটারি কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যায়। তাঁকে অন্য বন্দীদের সঙ্গে ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের কাছে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আয়েজ উদ্দিনের স্ত্রীকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন।

রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলার মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে মাঠপর্যায়ের গবেষণা করে রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে রঙ্গপুর গ্রন্থে শহীদ আয়েজ উদ্দিনের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। এই গ্রন্থের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, শহীদ আয়েজ উদ্দিন তাঁর পেশাগত কাজের পাশাপাশি সৈয়দপুরে সাংস্কৃতিক আয়োজনে যুক্ত ছিলেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি তাঁর প্রাপ্য।

বাংলাদেশ রেলওয়ে বিশেষ প্রকাশনা রেল বাতায়ন–এ শহীদ আয়েজ উদ্দিনের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের শহীদ স্মৃতিসৌধে, চট্টগ্রাম রেলওয়ের প্রধান কার্যালয় সিআরপিতে এবং সৈয়দপুর রেলওয়ে বিভাগীয় অ্যাকাউন্টস অফিস চত্বরের স্মৃতিফলকে তাঁর নাম রয়েছে। সৈয়দপুর শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে।

গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান, ঢাকা