বিজ্ঞাপন
default-image

বালতি হাতে পানি আনতে যাচ্ছিলেন নাট্যজন কাজী আলী ইমাম। সঙ্গে তাঁর ভায়েরা ভাই (স্ত্রীর ছোট বোনের স্বামী) চিকিৎসক এ কে এম গোলাম মোস্তফা। পথে পাকিস্তানি ঘাতক সেনারা তাঁদের দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর চলে যেতে বলে। যেই তাঁরা কয়েক পা এগিয়েছেন, অমনি পেছন থেকে অবিরাম গুলি। আলী ইমামসহ পাঁচজন নিহত হন সেখানে।

শহীদ কাজী আলী ইমাম ছিলেন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম শাখার জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। নাট্যজন হিসেবেই চট্টগ্রামে পরিচিত ছিলেন তিনি। কলকাতার নাটকের দল বহুরূপীর সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রামে ১৯৫০ সালে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’। তাঁর নির্দেশনায় ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে মঞ্চস্থ করা মুক্তধারা নাটকটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। স্ত্রী মনি ইমামও অভিনয় করতেন। বড় ভাই কাজী হাসান ইমাম আবৃত্তি করতেন।

মুঠোফোনে কথা হলো তাঁর ছেলে কাজী কাঁকনের সঙ্গে। তিনিই জানালেন বিস্তারিত ঘটনা। কিছু তথ্য পাওয়া গেল তাঁর ‘আমার জনক’ নামের লেখায়। এটি রয়েছে রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি: ১৯৭১–এর পুনর্বিন্যাসকৃত প্রথম খণ্ডে।

আলী ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে। চট্টগ্রামের লালখান বাজারে ছিল তাঁদের বাড়ি। পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করলে আশপাশ থেকে আত্মীয়রা তাঁদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন।

কাজী কাঁকন জানান, পুলিশ লাইনসের ভেতরে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। জগ–বালতি হাতে পানি আনতে গেলে সেনারা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিত। আলী ইমাম ও গোলাম মোস্তফা ৩০ মার্চ সকালে বালতি হাতে পানি আনতে বের হন। পথে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের জেরার মুখে পড়েন। জেরা শেষে চলে যেতে বললেও কয়েক কদম সামনে এগোনো মাত্র পেছন থেকে ঘাতক সেনারা গুলি চালাতে থাকে। তাঁরা দুজন ও আগে লাইনে দাঁড় করানো তিনজন, মোট পাঁচ নিরীহ মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকে সেখানে।

কেউ লাশ আনতে যেতে সাহস পাননি। অবশেষে আলী ইমামের বৃদ্ধা মা উম্মে সোলেমা খাতুন এগিয়ে যান সড়কে পড়ে থাকা ছেলে ও সন্তানসম হতভাগ্য অন্য বাঙালিদের লাশের দিকে। কাঁকন জানান, তাঁর দাদি পাকিস্তানি সেনাদের নিষেধ না শুনে এগিয়ে গেলে ঘাতকেরা আর বাধা দেয়নি। পরে একে একে তাঁর মা মনি ইমাম, গোলাম মোস্তফার স্ত্রী তাঁর সেজ খালা রওশন আরা বেগম, বড় খালা হেনা ইমাম ও মেজ খালা জেরিন বেগম মিলে মৃতদেহ দুটি সড়ক থেকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসেন।

কাঁকন জানালেন, এ ঘটনার পর তিনি ও ছোট ভাই কাজী শিখর সীমান্ত পার হয়ে সাবরুম দিয়ে ভারতে চলে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে তিনি ২ নম্বর ও তাঁর ভাই ১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি তখন উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে এবং তাঁর ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন।

কাঁকনের মা কাজী মনির বয়স এখন ৮৮ বছর, একটু স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছেন, তবে সুস্থ আছেন। চট্টগ্রামেই থাকেন সবাই মিলে সেই আগের বাড়িটিতেই।


গ্রন্থনা: আশীষ–উর–রহমান