বিজ্ঞাপন
default-image

উদীয়মান সংগীতশিল্পী ছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের আব্রাহাম মল্লিক। উত্তরাঞ্চলের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করতেন তিনি। ১৯৭০ সালের বড়দিনের অনুষ্ঠানে ‘ও আমার দেশের মাটি’—এই দেশাত্মবোধক গান গেয়েছিলেন আব্রাহাম। তাঁর ব্লেজারের পকেটে শোভা পাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিল পাকিস্তানপন্থী প্রতিবেশী বিহারিরা। পরিণতি হয়েছিল মারাত্মক।

পাকিস্তান আমলে বিহারি–অধ্যুষিত সৈয়দপুরে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ছিল বেশ কঠিন। বিহারি বলে পরিচিত অবাঙালিরা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নানাভাবে চাপে রাখত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের ছত্রচ্ছায়ায় এই বিহারির দল নৃশংস হয়ে ওঠে। সৈয়দপুরে তারা বাঙালিদের বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতনসহ বর্বর হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে।

এই নরঘাতক সশস্ত্র বিহারির দল একাত্তরের ১৫ এপ্রিল সৈয়দপুর শহরের নতুন বাবু পাড়ার আব্রাহামদের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তারা আব্রাহামের মা সরোজিনী মল্লিক ও মেজ ভাই যাকোব মল্লিককে ঘর থেকে টেনে বের করে এনে বারান্দায় ফেলে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। আব্রাহামের ওপর বিহারিরা নাখোশ থাকায় তিনি বাড়িতে না থেকে প্রতিবেশীর বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতেন। মা ও ভাইয়ের আর্তনাদ শুনে তিনি আর লুকিয়ে থাকতে পারেননি। একটি লোহার রড নিয়ে বাড়িতে এসে উন্মত্ত বিহারিদের কবল থেকে মা ও ভাইকে রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু রক্তপিপাসায় মত্ত খুনির দলের কাছে তাঁর একার প্রতিরোধ টিকতেই পারেনি। খুনির দল আব্রাহামকে আটকে মারধর করে বাড়ির পেছনে ফায়ার সার্ভিসের পুকুরপাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। প্রতিবেশীদের অনেকেই সেদিন এই মা ও দুই ছেলের নির্মম হত্যাকাণ্ড দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু কেউ ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি তাঁদের রক্ষায়। এই প্রতিবেদকের কাছে কেঁদে কেঁদে সেই দুঃসহ দিনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন শহীদ আব্রাহামের ছোট বোন সিলভিয়া অ্যানি মল্লিক।

সিলভিয়া সৈয়দপুর শহরের কুন্দল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। আব্রাহাম মল্লিকের বাবা দ্বিজেন্দ্রনাথ মল্লিক ছিলেন রেলওয়ে কর্মচারী। শহীদ স্ত্রী–সন্তানের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ১০ জানুয়ারি মারা যান। দারুণ তবলা বাজাতেন। তাঁকে সবাই নাদুদা ডাকতেন। সিলভিয়া বলেন, তাঁরা চার বোন, তিন ভাই। ছাত্রলীগ নেতা আব্রাহাম স্থানীয় কায়দে আজম কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। চারদিকে তখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর উত্তাল অবাঙালি অধ্যুষিত সৈয়দপুর ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আব্রাহামকে দেখা যেত মিছিলের পুরোভাগে। প্রতিবেশীরা অবশ্য আব্রাহামকে হুঁশিয়ার করেছিলেন। এতে মোটেও বিচলিত ছিলেন না তিনি। সৈয়দপুরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল একাত্তরের ২৪ মার্চ। এরপর অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন শহরের বাঙালিরা। ১৫ এপ্রিল ছিল বাঙালির নববর্ষ পয়লা বৈশাখ। ওই দিন শহরজুড়ে তাণ্ডব চালায় বিহারিরা। পথে কোনো বাঙালিকে পেলেই হত্যা করতে থাকে।

এমনকি তারা ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল। এমন শঙ্কা থেকে বাবা দ্বিজেন্দ্রনাথ মল্লিক, বোন রেখা রানি মল্লিক, রেবা রানি মল্লিক, রেনুবালা মল্লিক ও শিশু ভাই রিচার্ড সাইমন মল্লিকসহ সিলভিয়া আশ্রয় নেন খ্রিষ্টান পাড়ার সিস্টার কুঠিতে। তাঁদের নিজের বাড়িতে ছিলেন কেবল মা সরোজিনী মল্লিক আর মেজ ভাই যাকোব মল্লিক। পাশের বাড়িতে ছিলেন আব্রাহাম মল্লিক। তাঁদের তিনজনকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন বিহারি নেতা ইজহার আহমেদ ও রুস্তম আলী।

সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী শিল্প সাহিত্য সংসদের সভাপতি ম. আ. শামীম বলেন, আব্রাহাম ছিলেন উঁচু দরের শিল্পী। কিন্তু বিহারিরা তাঁর প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেয়নি। সৈয়দপুর শহরের শহীদদের স্মরণে নির্মিত ‘স্মৃতি অম্লান’ সৌধে আব্রাহাম ও তাঁর শহীদ স্বজনদের নাম লেখা আছে। এ ছাড়া শহরের রেলওয়ে পার্কের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভেও তাঁদের নাম রয়েছে।

গ্রন্থনা: এম আর আলম, সৈয়দপুর, নীলফামারী