বিজ্ঞাপন
default-image

নিজ গ্রামে সাংস্কৃতিক চর্চা, শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন মানিকগঞ্জের আবু ইলিয়াস মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন উচ্চবিদ্যালয়, গড়ে তুলেছিলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাঁদের পুরো পরিবারই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গ্রামের ছাত্র ও যুবসমাজকে সংগঠিত করেন। নিজেও সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে এর আগেই অবাঙালিদের সহায়তায় আলাউদ্দিন ও তাঁর ছোট ভাই জাকিউদ্দিনকে ঢাকায় গাড়ি থেকে নামিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ছাড়া তাঁদের আরেক ভাই জিয়াউদ্দিনকেও তাঁর কর্মস্থল চট্টগ্রামে হত্যা করে হানাদার সেনারা।

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার হোগলাকান্দি গ্রামে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। পদ্মায় বসতবাড়ি ভেঙে গেলে তাঁর পরিবার শিবালয়ের শাকরাইল গ্রামে চলে আসে। তাঁর বাবা দলিল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ব্রিটিশ আমলের প্রখ্যাত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা কুলসুমা খাতুন গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে আলাউদ্দিন ছিলেন সবার বড়। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নিজেদের বাড়িতে বেড়ে ওঠেন আলাউদ্দিন। তিনি আরমানিটোলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পাট বোর্ডে কর্মজীবন শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি এখানে সহকারী পরিচালক ছিলেন।

শহীদ আলাউদ্দিন ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শাকরাইল পল্লী উন্নয়ন সমিতি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এ ছাড়া ১৯৭০ সালে শিক্ষা প্রসারে প্রতিষ্ঠা করেন শাকরাইল হাইস্কুল।

পাকিস্তানি হানাদার সেনারা ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করলে তিনি তরুণদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেন। একাত্তরের ২৮ এপ্রিল মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও তাঁর ছোট ভাই আবু ইলিয়াস মোহাম্মদ জাকিউদ্দিন ঢাকা থেকে নিজেদের ফক্সওয়াগন গাড়িতে করে গ্রামের বাড়ি শাকরাইলে ফিরছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া। জাকিউদ্দিন ছিলেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক এবং জাতীয় হকি দল ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের খ্যাতনামা খেলোয়াড়। তিনিই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গাবতলী সেতুর কাছে এলে অবাঙালিরা হানাদার সেনাদের নিয়ে তাঁদের আটক করে। সেদিন মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের কুখ্যাত বিহারি ও হানাদার সেনারা ঢাকায় জঘন্য গণহত্যা চালায়।

তারা আলাউদ্দিন ও জাকিউদ্দিন দুই ভাইকে সেদিন গাড়ি থেকে নামিয়ে জবাই করে হত্যা করে তুরাগ নদে লাশ ভাসিয়ে দেয়। ওদিকে তাঁদের আরেক ভাই আবু ইলিয়াস মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় হানাদার সেনারা হত্যা করে। তিনি চট্টগ্রামে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জেলা ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সপরিবার সেখানে বসবাস করতেন। দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা সেনানিবাসে শহীদ আলাউদ্দিনের ফক্সওয়াগন গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। গাড়িটি দেখে পরিবারের স্বজনেরা তাঁদের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মানিকগঞ্জ সদরের খাবাশপুর আদর্শ ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক এবং মুক্তিযুদ্ধ পাঠ ও গবেষণা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শহীদ বুদ্ধিজীবী আলাউদ্দিনের ছবি ও তথ্য পাঠান। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে তাঁর মাঠপর্যায়ে গবেষণার তথ্য নিয়ে প্রকাশিত স্মৃতি ও শ্রুতিতে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ বইতে আলাউদ্দিনের তথ্য রয়েছে।

শহীদ আলাউদ্দিনের ছোট ছেলে আহসান উদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মা আজিমা খাতুনকে সমবেদনা জানিয়ে একটি চিঠি ও দুই হাজার টাকা অনুদান পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধু তাঁর কার্যালয় ও ধানমন্ডির বাসভবনে মাকে ডেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তবে তাঁর বাবা আলাউদ্দিনসহ দুই চাচার কেউই শহীদ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাননি। এ জন্য তাঁদের পরিবারে গভীর মনোবেদনা রয়েছে।

গ্রন্থনা: আবদুল মোমিন, মানিকগঞ্জ