বিজ্ঞাপন
default-image

পেশা ছিল তাঁর শিক্ষকতা। তবে সেটি নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তিনি সর্বজনপরিচিত ছিলেন ‘আইয়ুব আলী মাস্টার’ নামেই। শিক্ষকতার পাশাপাশি তরুণ আইয়ুব আলী এলাকায় সাংস্কৃতিক আয়োজনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। দেশপ্রেম ছিল তাঁর প্রবল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বর্বর হানাদার সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আইয়ুব আলী ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে ভারতের কোটগছ এলাকা থেকে যুদ্ধ করতে করতে পঞ্চগড়ে আসেন তিনি। এ সময় আমবিক্রেতা সেজে পরিস্থিতি রেকি করতে স্থানীয় জগদল হাট এলাকায় যান। সেখানে কতিপয় রাজাকার তাঁকে চিনে ফেলে আটক করে তুলে দেয় হানাদার সেনাদের কাছে। বর্বর সেনারা আইয়ুব আলীর হাত-পা বেঁধে ফেলে। তারপর তাদের গাড়ির পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় পঞ্চগড় শহরে। পঞ্চগড়ের চৌরঙ্গী মোড়ে অচেতন রক্তাক্ত আইয়ুব আলীকে একটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয় তারা। সেখানেই মারা যান দেশের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী মাস্টার।

শহীদ আইয়ুব আলীর জন্ম ১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার আছিম এলাকায়। বাবার নাম কোরবান আলী। সেখানে স্থানীয় আছিম উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে চলে আসেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার কালান্দিগঞ্জ-ময়নাকুড়ি এলাকায় চাচা আবেদ আলী আহম্মেদের বাড়িতে। তেঁতুলিয়ায় এসে স্থানীয় মনিগছ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।

শিক্ষকতার পাশাপাশি আইয়ুব আলী স্থানীয়ভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিতেন। নিজ উদ্যোগে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে নাট্যদল তৈরি করেছিলেন। এর পাশাপাশি বাম রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পানিঘাটা মুজিব ক্যাম্পের প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিয়ে কোটগছ এলাকা থেকে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। নিজে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি এলাকার অন্য যুবকদেরও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন।

শহীদ আইয়ুব আলীর সহযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আইয়ুব আলী স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের নামের মিল থাকায় শহীদ আইয়ুব আলী মাস্টারের সঙ্গে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমরা দুজন-দুজনকে মিতা বলে ডাকতাম। তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি সফল সংগঠকও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তেঁতুলিয়া ছিল মুক্তাঞ্চল। ওই সময় একদিন আমি শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন দেখি একটা রাইফেল কাঁধে নিয়ে আইয়ুব আলী মাস্টার আমার কাছে এসে বলেন, “মিতা, আর বসে থাকার সময় নেই, চলেন যুদ্ধে যেতে হবে।” আমি তাঁর সেই কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে চলে যাই। যুদ্ধ চলাকালে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আইয়ুব আলী মাস্টারকে যখন পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে, তখন আমাদের এলাকায় “আইয়ুব আলী মাস্টার মারা গেছেন” বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এমন খবর শুনে আমার পরিবারের লোকজন আমি মারা গেছি ভেবে বাড়িতে মিলাদ পড়িয়েছিলেন। পরে যুদ্ধ শেষে যখন আমি বাড়িতে ফিরে আসি, তখন পরিবারের লোকজন আমাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন, অনেকে ভয়ও পেয়েছিলেন।’

শহীদ আইয়ুব আলী মাস্টারের চাচাতো ভাই তেঁতুলিয়ার কালান্দিগঞ্জ-ময়নাকুড়ি এলাকার বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, শহীদ আইয়ুব আলীর নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি তালিকায় রয়েছে।

গতিধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. নাজমুল হকের পঞ্চগড় জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে শহীদ আইয়ুব আলীর জীবনী রয়েছে। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরে ‘শহীদ আইয়ুব আলী সড়ক’ নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

গ্রন্থনা: রাজিউর রহমান, পঞ্চগড়