বিজ্ঞাপন
default-image

সত্তরের দশকে ললনা নামে নারীদের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা এ দেশের রুচিশীল পাঠকের প্রশংসা পেয়েছিল।

পত্রিকাটির মাধ্যমে অনেক নতুন লেখকেরও জন্ম হয়। মুহাম্মদ আখতার ছিলেন এই পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই পত্রিকার সঙ্গেই তিনি যুক্ত ছিলেন।

ললনা প্রকাশিত হতো সেগুনবাগিচার ইস্টার্ন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস লিমিটেডের পক্ষ থেকে।

অবিবাহিত মুহাম্মদ আখতার থাকতেন পুরানা পল্টনের একটি বাড়িতে। ওই বাড়িতেই থাকত আরও কয়েকজন।

তারা পৃথিবী নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করত। সেটি প্রকাশিত হতো ওই বাড়ি থেকেই। একাত্তরে এই পত্রিকাটির স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা ছিল। পত্রিকার সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্য।

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাপ্রিয় মুহাম্মদ আখতারকে তাঁর বাসা থেকে আলবদররা ধরে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায়।

মুহাম্মদ আখতারের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় তাঁর বন্ধু সৈয়দ শাহজাহানের লেখায়। ‘আমার বন্ধু’ শিরোনামে রচনায় তিনি লিখেছেন, ‘২৫ মার্চের কালরাত্রি শেষে কারফিউ উঠে যাবার পর আখতার পথে নেমে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে নতুন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হন। তখন স্বাধীনতা তার ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়।

তাঁর বাসা থেকেই ভবিষ্যতের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে যাবার দিশা পেতে শুরু করেন। এমনকি অনেককে তিনি প্রথমে নিজের বাসায় রেখে পরে কুমিল্লার রামচন্দ্রপুরের পথে আগরতলা যাবার পথ-ঘাট চিনিয়ে দেন।

ঢাকার আশপাশের সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধারাও আড়ালে তার বাসায় হাজির হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে তার বাসা থেকেই অনেকে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির খবরাখবর পেতেন।

‘এদিকে তার বাসারই অন্য অংশে অবস্থিত রাজাকার-আলবদরদের একটি শাখা অফিস থেকে সব সময় আখতারের গতিবিধির খবরাখবর রাখা হচ্ছে, এটা জেনেও আখতার কখনো তার কাজ থেকে বিরত হয়নি।

বরং সে সময় আখতার ছিলেন অপেক্ষাকৃত বেশি সরব। তার মুখে ঝরে পড়ত রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে বিষোদগার।

একদিকে আখতারের সরব কণ্ঠ অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তার কার্যক্রম আখতারকে রাজাকার- আলবদরদের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করে।

তাই মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে আখতারকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বধ্যথভূমিতে।

স্বাধীনতার উষালগ্নে বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের লাশের পাশে আখতারের লাশ দেখে শিউরে উঠেছিলাম।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

স্বল্প ও মৃদুভাষী মুহাম্মদ আখতারের জন্ম টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি গ্রামে ১৯৪০ সালের ১৯ জানুয়ারি। বাবা হাফেজ মীর মো. হাসান।

১৯৫৭ সালে তাঁর স্কুলশিক্ষা সম্পন্ন হয় টাঙ্গাইলে। এরপর ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করেন।

জীবিকার প্রয়োজনে ষাট দশকের মাঝামাঝি ঢাকায় এসে তিনি সাংবাদিকতা, বিশেষ করে মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন।

মুহাম্মদ আখতারের প্রথম কর্মজীবন শুরু হয় দৈনিক ইত্তেফাকে, সংশোধনী বিভাগে। এখানে যোগ দেওয়ার পর ঢাকার সাহিত্য মহলে তাঁর পদচারণা শুরু হয়।

এ সময় তাঁর মধ্যে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার নিয়েও ভাবনা সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে তিনি কয়েকটি নিবন্ধ লেখেন।

কিছুদিন পর তিনি রেডিও পাকিস্তানের এলান পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর পত্রিকাটি নতুন রূপ লাভ করে। তিনি এই পত্রিকাটি বর্ণাঢ্য করেন এবং সেটি পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়।

পরে মুহাম্মদ আখতার এলান পত্রিকার কাজ ছেড়ে ইস্টার্ন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস লিমিটেডে যোগ দেন। এখান থেকেই প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক ললনা

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

<[email protected]>

সূত্র: ৪ জানুয়ারী, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত