বিজ্ঞাপন
default-image

কুড়িগ্রাম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন আবদুল ওয়াহাব তালুকদার। ক্রীড়ামোদী ও সংস্কৃতিমনা এই শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা খুব পছন্দ করত।

একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিজ গ্রামে চলে যান। ২৫ মার্চের কিছুদিন পর তিনি ভারতে গিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

পরে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন বামনহাট যুব শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ নিযুক্ত হন।

৭ আগস্ট সকালে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এক রেলসেতুতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে দেখতে এসেছিলেন তিনি।

এ সময় তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আক্রান্ত হন। তিনি গুলিতে আহত হন। সেখানে রেললাইন ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ।

তিনি দৌড়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। সেনারা জঙ্গল থেকে তাঁকে খুঁজে বের করে। সেখানেই তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে একটি ডোবায় ফেলে চলে যায়।

এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর বড় ছেলে মিজানুর রহমান তালুকদারের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘বামনহাট থেকে কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে বাবা এসেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সিংঝাড় গ্রামসংলগ্ন বগনী সেতুতে অবস্থানরত একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলোচনা করতে।

আলোচনার একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাবাকে জানায়, “স্যার, আমরা এখনো ভাত খাইনি।

পাশের বাড়িতে ভাত রান্না করতে দিয়েছি।” তখন বাবা তাঁদের খেয়ে আসতে বলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে পাহারায় থাকেন।

‘তখন বিকেল। একদল পাকিস্তানি সেনা রেললাইন ধরে সেখানে এসে অতর্কিতে আক্রমণ করে।

রেললাইনটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। পাহারারত মুক্তিযোদ্ধা চিৎকার দেওয়ামাত্র সেনারা ব্রাশফায়ার করে।

ওই মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন। অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন।

‘বাবা রেললাইন ধরে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি তখন ৩২ বছরের যুবক এবং লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী।

ফলে সেনারা তাঁকে সহজেই দেখতে পায়। তাঁকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। বাবা আহত হন। আহত অবস্থায় তিনি ঝোপের ভেতর আশ্রয় নেন।

‘সেনারা তাঁকে খুঁজে বের করে বুকসহ দেহের বিভিন্ন অংশ নৃশংসভাবে বেয়নেটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত করে। পরে তাঁর রক্তাক্ত দেহ পার্শ্ববর্তী একটি ডোবায় ফেলে চলে যায়।’ (সাক্ষাৎকার, ২৬ জানুয়ারি ২০১৪)।

আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের মরদেহ পরে উদ্ধার করে ভারতের অন্তর্গত বগনী নদীর কিনারে কালমাটি মসজিদ চত্বরে সমাহিত করা হয়।

তাঁর সমাধিস্থল এখন নদীভাঙনের কারণে হুমকির মুখে। পরিবারের সদস্যরা তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের পৈতৃক নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের অন্তর্গত দিনহাটা মহকুমার কালমাটি গ্রামে।

১৯৪৩ সালের ৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছামান আলী তালুকদার, মা সালমা বেগম।

পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার সময় তাঁর বাবা-চাচা ভুরুঙ্গামারী থানার সিংঝাড় গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

ভুরুঙ্গামারী পাইলট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৫৮), রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ (১৯৬০) ও বিএ (১৯৬২) পাস করেন।

১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। ১৯৬৫ সালে তিনি কুড়িগ্রাম কলেজে যোগ দেন।

তাঁর নামে কুড়িগ্রাম শহরে একটি সড়ক ও কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে একটি ছাত্রাবাস রয়েছে।

তিন ছেলের জনক তিনি। তাঁরা হলেন মিজান, শামিম ও স্বপন। প্রথম স্ত্রী মনোয়ারা বেগম সন্তান জন্ম দেওয়ার এগারো দিন পর মারা যান। পরে তিনি মেশরুন নাহারকে বিয়ে করেন।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

[email protected]

ঘোষণা: শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের অনেকের ঠিকানা ও ফোন নম্বর না থাকায় আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাঁদের ওপরের মেইলে কিংবা ০১৭২৭৫২২০১৬ মোবাইল নম্বরে অথবা সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।-সম্পাদক

সূত্র: ২৭ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত