বিজ্ঞাপন

চিকিৎসক, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

default-image

নিজের বাড়ির পুকুর পাড় দিয়ে যাচ্ছিলেন চিকিৎসক মাহতাবউদ্দিন আহমেদ। অপর পাড় থেকে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা রাইফেলের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর বুক। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে শহীদ হন তিনি।

একাত্তরের ২ এপ্রিল ভোররাতে পাকিস্তানি সেনারা কেরানীগঞ্জে গণহত্যা চালায়। প্রতিবেশী মাসুদ মিয়ার শ্যালক গুলিতে আহত হন। খবর পেয়ে চিকিৎসক মাহতাবউদ্দিন তাঁদের বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে নিজের বাড়িতে ফেরেন। এরপর দুপুরে জুমার নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় খবর পান, তাঁর বোনের বাড়িতে সেনারা হামলা করে ভাগনে রব্বানীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে পুকুর পাড় দিয়ে এগিয়ে গেলে হানাদার সেনারা অপর পাড় থেকে গুলি করে। তাঁর বুকে ও মুখে ছয়টি গুলি লাগে। পরে হানাদার সেনারা তাঁর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।

শহীদ মাহতাবউদ্দিন আহমেদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জের কালিন্দী ইউনিয়নের মধ্যচড়াইল গ্রামে। বাবা মো. আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা সখিনা বেগম। তাঁরা সাত ভাই ও এক বোন। মাহতাবউদ্দিন ১৯৪৩ সালে জামালপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক ও ১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। প্রথম দিকে তিনি কিছুদিন পাকিস্তানের পার্ক মেডিসিন কোম্পানিতে চাকরি করেন। পরে নিজের এলাকায় চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ওই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও ছিলেন।

মাহতাবউদ্দিন আহমেদের ছেলে মইনুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৪ সালে তাঁরা কেরানীগঞ্জ ছেড়ে পুরান ঢাকার মৌসুন্দি এলাকায় চলে আসেন। তিনি ব্যবসা করেন। তাঁর মা মাজেদা বেগম বার্ধক্যজনিত কারণে এখন শয্যাশায়ী। তাঁর তিন বোন গৃহবধূ। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সমবেদনা জানিয়েছিলেন এবং দুই হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো সরকারি সহযোগিতা তাঁরা পাননি।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শহীদ চিকিৎসক মাহতাবউদ্দিন আহমেদের ব্যবহৃত চিকিৎসাসামগ্রী নিদর্শন হিসেবে রয়েছে। সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ ও মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত আহমদ রফিক সম্পাদিত স্মৃতি বিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ বইতে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের সামনে শহীদ চিকিৎসকদের নামফলকেও তাঁর নাম রয়েছে।

গতকাল শনিবার কেরানীগঞ্জে শহীদ মাহতাবউদ্দিনের বাড়িতে গেলে তাঁর এক নাতি কালিন্দী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আরিফুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বাড়ির পাঁচটি ঘর ও মাহতাবউদ্দিনের একতলা বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। মাহতাবউদ্দিনের পরিত্যক্ত ভিটায় প্রতিবেশীরা বাঁশের মাচা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চারা রোপণ করেছেন।

শহীদ মাহতাবউদ্দিন চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা ও শিক্ষা বিস্তারে উৎসাহী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই চরাইল যুব সমিতি ও চরাইল স্পোর্টিং ক্লাব গড়ে ওঠে। তাঁর উদ্যোগে একটি প্রাথমিক ও একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়েছে।

গ্রন্থনা: ইকবাল হোসেন, কেরানীগঞ্জ