বিজ্ঞাপন
default-image

‘বেইজ ফর অল স্টেশনস, ভেরি ইম​েপার্ট্যান্ট মেসেজ। প্লিজ কিপ নোট।...উই আর অলরেডি অ্যাটাক্টড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ। ওভার অ্যান্ড আউট।’ ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগে পুলিশ স্টেশনের ওয়্যারলেসে এই বার্তা প্রচার করেছিলেন পুলিশ সদস্য শাহজাহান মিয়া।

শাহজাহান মিয়ার এই বার্তা ছাড়া আরও কয়েকটি সূত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের সদস্যরা জেনে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানে আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। ফলে ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইনস ঘিরে ফেললে রাত ১২টা থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে দেন পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু ট্যাংক, মর্টার আর মেশিনগানের সঙ্গে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি তাঁরা। শতাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।

‘সকাল হওয়ার আগেই সেনাবাহিনীর আট-দশটা ট্রাকে করে লাশ সরিয়ে ফেলা হয়। আর আমরা যারা রাজারবাগ থেকে পালাতে পারিনি, তাদের দেড় শ জনকে বন্দী করা হলো,’ বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্য শাহজাহান মিয়া। গতকাল বুধবার প্রথম আলোর কাছে স্মৃতিচারণা করছিলেন তিনি।

২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে যে সামরিক অভিযানে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয় রাজধানী ঢাকাজুড়ে, তার তিনটি লক্ষ্যবস্তুর একটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। তবে এখানে প্রথম প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় পাকিস্তানি বাহিনীকে।

ওই হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আরও তিন মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা, আবদুল মালেক খান ও আবদুল মতিন তরফদার প্রথম আলোকে জানান, এই প্রতিরোধযুদ্ধ ক্ষুব্ধ করেছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে। ফলে ওই রাতে তারা রাজারবাগের পুলিশ ব্যারাকগুলোতে আগুন ধরিয়ে নির্বিচারে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করতে থাকে।

default-image

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র-এর অষ্টম খণ্ড এবং পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা ও মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গ্রন্থেও এসব কথা উঠে এসেছে। শহীদ পুলিশের রক্তের ঋণ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘সেদিন আট শ পাক সেনা পুলিশ লাইনস আক্রমণ করে। রাজারবাগে পুলিশেরা প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে থ্রি নট থ্রি দিয়ে। এ সময় পাকবাহিনী একটু থমকে গেলেও ট্যাংক, মর্টার ও হেভি মেশিনগান নিয়ে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের গুলি শেষ হয়ে গেলে জীবিত পুলিশ সদস্যরা যে যেভাবে পারে পালিয়ে যায়।’

অভিযান শেষে পরদিন ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকক্ষ যখন ওয়্যারলেস বার্তায় রাজারবাগে পুলিশের মৃতের সংখ্যা জানতে চাইছিল, তখন বলা হয়, এখনো গোনা শেষ হয়নি। তবে সংখ্যা অনেক।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সাবসেক্টর অধিনায়ক এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এ এস এম সামছুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাঙালি পুলিশ যে প্রতিরোধ করতে পারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসলে সেটা ভাবেনি। তাই ২৫ মার্চের পুলিশ প্রতিরোধে ক্ষিপ্ত হয়ে পাক বাহিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাংক নিয়ে এসে সেখানে ভয়াবহ হামলা চালায়। এখানে অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। এদের লাশ সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য

পুলিশ লাইনসের ওই সময়কার বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা আভাস পাই, ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ হতে পারে। আমি তখন ওয়্যারলেস বেইজ স্টেশনের দায়িত্বে। তেজগাঁও পেট্রলপাম্প থেকে রাত ১০টার দিকে একটি মেসেজ আসে, “পাকিস্তানি সেনাভর্তি ৩৭টি ট্রাক নগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।” আমরা তখুনি প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকবাহিনী রাজারবাগ ঘিরে ফেলে। এ সময় আমি সারা বাংলাদেশে ওয়্যারলেসে আক্রমণের এই খবর জানিয়ে আত্মরক্ষার জন্য তৈরি হতে বলি।’

শাহজাহান বলেন, ‘পাকিস্তানিরা বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছিল। জেনারেটর চালু করতে গিয়েও পারলাম না। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে রাজারবাগে আগুনের ফুলকি উড়তে লাগল। আমি চারতলার ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলাম। একটা থ্রি নট থ্রি নিয়ে লড়াই করে চলেছি। ফজরের আজান পর্যন্ত আমিসহ ১০০ জনের মতো পুলিশ টিকে ছিলাম। ভোর পাঁচটার দিকে আমাদের ঘিরে ফেলে বন্দী করে আর্মি।’

সেদিন কত পুলিশ সদস্য মারা গিয়েছিলেন জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, ‘ভোরের দিকে পাকিস্তানিরা আট-দশটি ট্রাকে করে লাশ বের করে নিয়ে যায়। আমার ধারণা, অন্তত দেড় শ পুলিশ শহীদ হয়েছিল। আমরা দেড় শ জনের মতো বন্দী হলাম।’

রাজারবাগে নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ কোথায় নেওয়া হয়েছিল, জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, ‘আমরা ধারণা করি, এসব লাশ হয়তো নদীতে বা অন্য কোথাও ফেলা হয়েছিল। ২৯ মার্চ আমি যখন মিলব্যারাক পুলিশ লাইনসে যাওয়ার জন্য লোহারপুলে আসি, তখন ওই খালে আর বুড়িগঙ্গায় শত শত লাশ দেখেছিলাম।’

সেদিনকার প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজারবাগে সেদিন ইস্ট পাকিস্তান প্রভিনসিয়াল রিজার্ভ ফোর্সের (ইপিপিআরএফ) সাড়ে তিন শ এবং আমাদের স্পেশাল আর্মড ফোর্সের (এসএএফ) পাঁচ থেকে ছয় শ পুলিশ ছিল। আমরা রাত থেকেই প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করি। পাকবাহিনী তখন ইপিপিআরএফের চারটি টিনশেড ব্যারাক আগুনে পুড়িয়ে দেয়। মূল ভবনটিও গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। ভারী অস্ত্রের কাছে আমরা টিকতে পারলাম না। ভোরে গ্রেপ্তার হলাম। আমার মনে আছে, ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানি সেনারা আট-দশটা ট্রাকে করে নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ নিয়ে গিয়েছিল।’

ওই সময় ঢাকা পৌরসভার সুইপার পরিদর্শক সাজেব আলী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ২৬ মার্চ সকালে বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির প্রবেশপথে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা দশটি লাশ পড়ে থাকতে দেখি। ফাঁড়ির চারদিকে দেয়াল গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে। আমি একটি ঠেলাগাড়িতে করে সব লাশ ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে রেখে আসি। ২৮ মার্চ সকালে সব সরকারি কর্মচারীকে কাজে যোগদানের নির্দেশ দিলে আমি ঢাকা পৌরসভায় যাই। আমাদের ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে লাশ পরিষ্কার করতে বলা হয়। ২৯ মার্চ আমরা দুই ট্রাক লাশ তুলি। এগুলো ছিল পুলিশ, আনসারের। খাকি পোশাক পরা লাশ। আমরা অনেক মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছি।’

রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সম্প্রতি পুলিশের একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। এতে ২৫ মার্চের ওই গণহত্যার নানা স্মৃতিচিহ্নসহ মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অবদানের স্মারক স্থান পেয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আবিদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন পুলিশের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ১১শ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য। পুলিশের জাদুঘরে আমরা গর্বের সাথে এই ইতিহাস সংরক্ষণ করেছি।’