পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে শুরুতে বন্ধুদেশগুলোর পার্লামেন্টের সমর্থন পাওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। প্রয়োজনে জাতিসংঘ অথবা নেদারল্যান্ডসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যেতে চায় বাংলাদেশ।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই সব সূত্র বলছে, গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক আইনি পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ওই সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, বিষয়টি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তোলাটা কার্যকর হবে, নাকি সেটি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে তোলা হবে। নিউ ইয়র্ক কিংবা জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরে বিষয়টি তুলে ধরার চেয়ে নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যাওয়াটা ফলপ্রসূ হলে সেখানেই যাওয়ার উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৪৬ বছর আগের বিভীষিকাময় দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘ এবং নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) যাওয়ার সুযোগ আছে। তবে এই দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরতে বাংলাদেশকে যথেষ্ট প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করতে হবে।
আজ ২৫ মার্চ, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন বিভীষিকাময় রাত আর আসেনি। ১৯৭১ সালের ওই কালরাতে বাঙালি জাতিসত্তাকে পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। একই সঙ্গে এই দিনে শুরু হয়েছিল বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম।
১১ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণার ব্যাপারে জাসদের সাংসদ শিরীন আখতারের উত্থাপন করা প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রসঙ্গে সংসদের প্রস্তাবে আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়। এর আগে ২০ মার্চ মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়।
সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। ফলে ২৫ মার্চ বিশ্বজুড়ে গণহত্যা দিবস ঘোষণার সুযোগ নেই। গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও শাস্তি-সংক্রান্ত জাতিসংঘের সনদটি ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর গৃহীত হয়। ১৯৫১ সালের ১২ জানুয়ারি এটি কার্যকর হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৪৩টি দেশ এই সনদে সই করেছে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী কোনো একটি জাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আংশিক বা পূর্ণাঙ্গভাবে ধ্বংসের জন্য এর সদস্যদের হত্যা, শারীরিক ও মানসিক চরম ক্ষতিসাধন, পরিকল্পিতভাবে লোকজনের জীবনের বা শরীরের আংশিক ক্ষতিসাধন, পরবর্তী প্রজন্ম বিকাশে বাধাদান গণহত্যার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, গণহত্যার স্বীকৃতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর এবং জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে। তাদের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের পর সরকার দেখবে কীভাবে কাজটি এগিয়ে নেওয়া যায়।
তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকেরা বলছেন, স্বীকৃতি আদায়ের কাজটি সহজ নয়। এ জন্য গণহত্যার মানচিত্র লাগবে, সংখ্যাসহ প্রমাণ লাগবে, ফরেনসিক প্রতিবেদনও প্রয়োজন। এসব প্রস্তুতি নিয়ে যথাযথভাবে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করতে হবে।
দ্য ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম যেসব অপরাধ ঘটেছিল, তা প্রমাণের জন্য জোরালো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। তার আগে এগুলো সংগ্রহ করার কাজটি বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ, যদিও তা অসম্ভব নয়।
তাঁর মতে, ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ইতিমধ্যেই পালিত হচ্ছে। ফলে জাতিসংঘে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। কারণ, গণহত্যার অভিযোগ কখনো তামাদি হয় না।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মনে করেন, গণহত্যার আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য বিশ্বজুড়ে জনমত গড়ে তোলার ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশের জনগণ ২৫ মার্চ প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবছর রাস্তায় জড়ো হলে এবং বছরের পর বছর এটি চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ এতে আকৃষ্ট হবে।
তিনি গতকাল এই প্রতিবেদককে জানান, এ মাসে একাত্তরের স্মারক হিসেবে ৭১টি ডাকটিকিট প্রকাশের কথা ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও হয়েছিল। অজানা কারণে তা এখন এপ্রিলে প্রকাশ হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অথচ ১ থেকে ৫ এপ্রিল ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলনে যোগ দিতে প্রায় দেড় শ দেশের স্পিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ঢাকায় আসছেন। তাঁদের হাতে ৭১টি ডাকটিকিটের স্মারক তুলে দেওয়া হলে গণহত্যার পক্ষে একটি জোরালো প্রচারণার সুযোগ ছিল।
সূত্র: ২৫ মার্চ ২০১৭, ১১ চৈত্র ১৪২৩, শনিবার, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।