মো. বজলুল গনি পাটোয়ারীর প্রথম যুদ্ধ ছিল কামালপুরে। সেদিন তিনি তাঁর অস্ত্র চালাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি গুলি লাগে তাঁর পেছনে থাকা এক সহযোদ্ধার বুকে। চোখের সামনেই ঢলে পড়েন তাঁর সহযোদ্ধা। এ দৃশ্য দেখে ভয় পেলেন না তিনি। বরং দীর্ঘদিন অস্ত্র না চালানোর অনভ্যস্ততা তাঁর মুহূর্তে কেটে গেল। মনে জেদও চাপল। তারপর বিরামহীনভাবে অস্ত্র চালাতে লাগলেন।
বজলুল গনি পাটোয়ারী এরপর যুদ্ধ করেন অনেক জায়গায়। তাঁর সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল ১৪ ডিসেম্বর এমসি কলেজে। সেদিন তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দলের সামনে হঠাৎ এসে থামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আর্টিলারি গান ও দুটি জিপের কনভয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সহযোদ্ধাদের বলেন গোলাবর্ষণ করতে। মর্টারের গোলায় জিপে আগুন ধরে যায়। হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। তারপর সেখানে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। সীমান্ত এলাকা থেকে অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধারা ১৩ ডিসেম্বর রাতে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজসংলগ্ন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থানের মুখোমুখি হন। তাঁরা অবস্থান নিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ৫০০ গজ দূরে টিলার ওপর। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ডি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন মো. বজলুল গনি পাটোয়ারী। তাঁদের কাছাকাছি ছিল লেফটেন্যান্ট হাফিজউদ্দীন আহমদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর) নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের বি কোম্পানি।
তখন খাদিমনগরে যুদ্ধ চলছিল। সেই প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভেতর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এত তাড়াতাড়ি সিলেট শহরে আসবেন, তা পাকিস্তানি সেনারা কল্পনাও করেনি। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক, হেলমেট ও অস্ত্রশস্ত্রও ছিল দেখতে পাকিস্তানি সেনাদের মতোই। এতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের দলের লোক বলেই ধারণা করেছিল। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করে তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞেস করে। মুক্তিযোদ্ধারা জবাব না দিয়ে নীরবে পরিখা খুঁড়ে অবস্থান নিতে থাকেন। সকালে মো. বজলুল গনি পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের সামনের রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি গান ও দুটি জিপের কনভয় এসে থামে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা ওই কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালান।
মো. বজলুল গনি পাটোয়ারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। জুলাইয়ের শেষ দিকে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডি কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান