পল্টন ময়দানে (বর্তমানে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম) ৩ মার্চ বিকেলে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন।
জনসমুদ্রে জনতার তুমুল করতালির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন, ক্ষমতা সমর্পণ করে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত স্বাধিকারকামী বাংলার মানুষ সরকারের সঙ্গে আর সহযোগিতা করবে না। কোনো কর-খাজনাও দেবে না।
সর্বাত্মক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের তিনি অফিস-আদালতে যাওয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। প্রচারমাধ্যমের প্রতি তিনি বাঙালির আন্দোলনের খবর প্রকাশ-প্রচারের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়।’ গণহত্যার বদলে সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার এবং বাংলার শাসনভার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘হয়তো এটিই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। ৭ মার্চ রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু সে সুযোগ আমাকে না-ও দেওয়া হতে পারে। তাই আপনাদের কাছে আমি বলে যাচ্ছি, আমি যদি না-ও থাকি আন্দোলন যেন না থামে। আমি থাকি আর না থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউই না থাকেন, তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। যেকোনো মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে। আমার সুস্পষ্ট নির্দেশ রইল, যে যেখানে থাকুন, নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করুন। আন্দোলনকে সংযত রাখুন।’ লাঠি হাতে বহু নারী এই সমাবেশে যোগ দেন। ঢাকার কোনো সমাবেশে নারীদের লাঠি হাতে নেওয়ার ঘটনা ছিল এটাই প্রথম।
স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ: পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। এতে বলা হয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সভামঞ্চে ইশতেহার পাঠ শেষে আনন্দে উদ্বেলিত জনতা নানা স্লোগান দেয়।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কবি সুফিয়া কামাল তাঁর একাত্তরের ডায়েরি বইয়ে লিখেছেন, ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এ সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সভায় গত রাতে নিহতদের লাশ নিয়ে আসা হয়। বিশাল সেই জনসমুদ্র শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয় এবং তাদের আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার দৃঢ় শপথ গ্রহণ করা হয়। সভায় বক্তব্য দেন প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও ডাকসু ভিপি এবং সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শ্রমিকনেতা আবদুল মান্নান। প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।’
ইয়াহিয়ার সম্মেলন, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাখ্যান: এ দিন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রধান ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সংসদীয় দলের নেতাদের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, নেতাদের কাছে আমন্ত্রণলিপি পাঠানো হয়েছে। সম্মেলনের দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক তাৎক্ষণিক বিবৃতিতে ইয়াহিয়ার এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, এই আমন্ত্রণের পটভূমিতে রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের পাইকারি হারে হত্যার বেদনাদায়ক অধ্যায়। সেই বীর শহীদদের রক্তের দাগ রাজপথের বুক থেকে এখনো শুকিয়ে যায়নি। বহু শহীদের দেহ দাফনের প্রতীক্ষায় পড়ে আছে। সেই মুহূর্তে এই সম্মেলনের আমন্ত্রণ নিষ্ঠুর তামাশা। সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত থাকার মুহূর্তে এই আহ্বান বন্দুকের নলের মুখে আমন্ত্রণেরই শামিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
সন্ধ্যায় পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঘোষণা করে, দলের প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় ইয়াহিয়ার আহূত এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
হরতালে দেশ অচল: বঙ্গবন্ধুর ডাকে এদিন ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সারা বাংলায় প্রথমবার সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকা ও অন্যান্য শহরসহ সারা দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় বেলা দুইটা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হলেও সারা দিন হরতাল পালিত হয়। ২ মার্চ রাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে ঢাকাতেই ২৩ জন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হয়েছিলেন। সকালে নিহতদের লাশ নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়।
৩ মার্চ হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও বিভিন্ন ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। ঢাকায় বুলেট, বেয়নেট ও বোমায় আহত ১২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মালিবাগে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের হুইপ আবদুল মান্নান সেনাবাহিনীর জওয়ানদের হাতে প্রহৃত হন। তাঁকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ড, হামলা, প্রতিহামলা, বন্দুকের গুলিবর্ষণ, সংঘর্ষ ও সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনায় পাঁচজন নিহত ও কয়েক শ লোক আহত হয়। চট্টগ্রামে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫। আহত হন কয়েক শ মানুষ।
রাজশাহীতে সেনাবাহিনী টেলিফোন অফিসের সামনে জনতার ওপর গুলি চালায়। আহতদের দেহ থেকে নিঃসৃত রক্ত দিয়ে লেখা হয় ‘বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
রংপুর শহরের স্টেশন রোডে মিছিলের ওপর এক অবাঙালি ঠিকাদার গুলি চালালে শঙ্কু সমঝদার নামে ১২ বছরের এক কিশোর এবং মকবুল নামে এক যুবক প্রাণ হারায়। গুলিতে প্রাণ হারান জজকোর্টের কর্মচারী ওমর আলী। রংপুর শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বিকেল চারটায় কারফিউ জারি করা হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয় সিলেটেও। ঢাকায় কারফিউ চলে রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত।
ঢাকা বেতার-টিভির ২০ জন শিল্পী সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে গণমাধ্যমের অনুষ্ঠান থেকে নিজেদের বিরত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
সূত্র: ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান ও আজাদ, ৪ মার্চ ১৯৭১; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড)
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান