বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহারে কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শনের পর বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে খুবই হইচই হচ্ছে। বাংলাদেশকে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না, বহুবার এ কথা বলা হয়েছে। ভারত সরকার যে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনকে কাজ করতে দিয়েছে, এটা কি এক অর্থে স্বীকৃতি নয়? তিনি বলেন, ‘আমি স্বীকৃতির বিরোধী নই।’ তবে তিনি বলেন, এখনই স্বীকৃতি দিয়ে সস্তা বাহবা পাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশকে ঠিক সময়েই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এখন প্রয়োজন বাংলাদেশের জনগণকে উদ্ধার করা। তাদের সাহায্য করা। কারণ, জয় তাদের হবেই। সমগ্র দেশের জনগণই তাদের পেছনে।

বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন উর্দু দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকেরা এদিন মুম্বাইয়ে পাকিস্তানের উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ দেখান। সেখানে একটি স্মারকলিপিও দেন।

ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী ও কমন্স সভায় লেবার পার্টির এমপি পিটার শোর দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে এখন ঘটছে পুরোনো পাকিস্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা এবং একটি নতুন জাতির জন্মের প্রসববেদনা। এখন বিশ্বের কাছে প্রশ্ন, এই নবজাতকটিকে নিদারুণ দুঃখকষ্টে ফেলে রাখা হবে, নাকি গণতন্ত্র ও শান্তির পথে কিছু ব্যবস্থা করা হবে। পিটার শোর জানান, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও দুজন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো সমাধানে রাজি নন।

প্রবাসে বাঙালি তৎপরতা

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুরোধে ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু ৩১ আগস্ট রোমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব শান্তি শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্য জেরি স্মিথের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানান। এরপর তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।

মোহাম্মদ হোসেন পরে সম্মেলনের সভাপতি সুইডেনের খ্যাতনামা অধ্যাপক অ্যালভেনের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ–সম্পর্কিত দলিলপত্র ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি চিঠি তাঁর হাতে দেন। অধ্যাপক অ্যালভেন পরদিন সম্মেলনের মূল অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

অসামরিক প্রশাসন ফেরানোর অপচেষ্টা

রাওয়ালপিন্ডিতে ঘোষণা করা হয়, অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের পরিবর্তে বেসামরিক গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিককে এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেছেন। টিক্কা খান একই সঙ্গে গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক—দুই পদেই ছিলেন। বলা হয়, বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ করা হলেও সেনাবাহিনী আগের মতো কাজ করবে।

ব্রিটিশ হাইকমিশন ঘোষণা করে, বিদেশি পত্রপত্রিকার ওপর পাকিস্তান সরকার সেন্সর বিধি প্রয়োগ করায় হাইকমিশন সব ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার বণ্টন স্থগিত রেখেছে। পাকিস্তান সরকার যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দূতাবাসকে পাকিস্তানবিরোধী রচনাসংবলিত পত্রপত্রিকা বিলি না করার জন্য অনুরোধ করেছে।

পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল এবং কিছু রাজাকারকে এদিন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থেকে কয়েকটি নৌকায় ছিরামিসি বাজারে যায়। রাজাকারদের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের ছিরামিসি উচ্চবিদ্যালয়ে জমায়েত করা হয়। এরপর সমবেত গ্রামবাসীকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে কোনো কোনো দলকে নিকটবর্তী পুকুরপাড়ে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। এভাবে পাকিস্তানি সেনারা ছিরামিসি গ্রামের ১২৬ জন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়া তারা জনশূন্য ছিরামিসি গ্রাম ও বাজারে লুটতরাজ চালায় এবং দোকান ও ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

গেরিলা অভিযান

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এদিন কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালান। একটি দল ঢাকার সূত্রাপুর থানায় বোমা নিক্ষেপ করলে পাকিস্তান–অনুগত কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়। আরেকটি গেরিলা দল কলাবাগানে পাকিস্তান–অনুগত পুলিশের ওপর হামলা করলে তিন-চারজন হতাহত হয়। আরও দুটি দল যথাক্রমে কালিগঞ্জ-ডেমরা এবং কালিগঞ্জ-টঙ্গীর মধ্যবর্তী বিদ্যুৎ পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে। নরসিংদীতে অন্য গেরিলারা শিবপুর থানায় হামলা করলে থানা ও রাজস্ব অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের ভাটেরচরের কাছে সড়ক সেতুতে অবস্থানরত গেরিলারা পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কিছু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে। গেরিলারা সেতুটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়।

শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৫০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদেরও বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও এগারো; প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, আবু সাঈদ চৌধুরী, ইউপিএল; স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান