বিজ্ঞাপন
default-image

স্বাধীনতার দাবিতে সারা বাংলা উত্তাল। বিক্ষোভ–সমাবেশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলছিল সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে।

সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫ নম্বর নির্দেশের প্রতিবাদে দেশ রক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সকালে ঢাকায় বিক্ষোভ করেন। সরকারি কর্মচারী সমন্বয় কাউন্সিলের বিবৃতিতে সামরিক নির্দেশ কার্যকর না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ হয়। ডিআইটি ভবন প্রাঙ্গণে সমাবেশ করেন টিভি নাট্যশিল্পীরা। সভায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। লেখক সংগ্রাম শিবিরের উদ্যোগে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় লেখক সমাবেশ। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) জনসভা ও মিছিল করে বায়তুল মোকাররম এলাকায়। সদরঘাটে ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের উদ্যোগে জনসমাবেশ এবং সন্ধ্যায় পল্টন ময়দানে কথাশিল্পী সম্প্রদায়ের কবিতাপাঠ ও গণসংগীতের আসর ছাড়াও আরও অনেক সংগঠন অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে মিছিল-সমাবেশ করে।

রাতে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশে ছুটিতে অবস্থানকারী কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালি কর্মচারীদের পশ্চিম পাকিস্তানে না গিয়ে নিজ নিজ এলাকার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান।

ওশান এন্ডুরাস নামে সমরাস্ত্রবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০ নম্বর জেটিতে নোঙর করে। বাংলাদেশের জন্য মন্টেসেলো ভিক্টরি নামে খাদ্যশস্যবাহী চট্টগ্রাম অভিমুখী জাহাজটি গতিপথ বদলে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এমন সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছেন। একাত্তরের ১৪ মার্চ এমন গুজবে সংশ্লিষ্ট মহলে কিছুটা হইচই পড়ে যায়।

সকালে ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালি খানের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনের আঙিনায় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, প্রেসিডেন্ট কি ঢাকায় এসেছেন? প্রশ্নকর্তা জবাব দেন, না। বঙ্গবন্ধু তখন আবার প্রশ্ন করেন, তাহলে দেখা হবে কীভাবে? প্রশ্নকর্তা নিরুত্তর। এরপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এলে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আমি রাজি আছি।’

রাতে দীর্ঘ এক বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নির্মূল করা যাবে না। বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে দিয়েছেন, আত্মসমর্পণ নয়, তাঁরা আত্মত্যাগের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ভুট্টোর প্রস্তাব: করাচিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) এক জনসভায় দলের প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রস্তাব দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ চায়, দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি দলই একসঙ্গে কাজ করুক। তিনি বলেন, ছয় দফার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই দাবি করছে।

করাচিতে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিরা প্রেসিডেন্টের কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির স্বার্থে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নিতে প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন। তাঁরা বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্প্রতিক অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সমুদয় অর্থ বাংলাদেশে আটকা পড়ে গেছে। এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে শিগগিরই পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এবং অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়বে। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান বাজার বাংলাদেশ।

সূত্র: ইত্তেফাক দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ মার্চ ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।