বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার পর সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো দল ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে—২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টার পর—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর (পরে ব্রিগেডিয়ার) জেড এ খান।

আটক হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ২৬ মার্চের এক প্রতিবেদনে এ ঘোষণার উল্লেখ করা হয় এভাবে, ‘পাকিস্তানে আজ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুই অংশের পূর্বাঞ্চলকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলি ছোড়া হয়, তখন রেডিও পাকিস্তানের একটি তরঙ্গে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হলো আগে রেকর্ড করা বাণী, যেখানে শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন।’

ওয়্যারলেসে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজ থেকেও শোনা যায়। এই দিনটিতে পূর্ব বাংলার ইতিহাস নতুন দিগন্তের দিকে মোড় নেয়। সূচনা ঘটে মুক্তিযুদ্ধের।

চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা: ২৬ মার্চ বেলা ২টা ১০ মিনিট এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ পাঠ করা হয়। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার নেতা এম এ হান্নান ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে নিজ নামে এ ঘোষণা পাঠ করেন।

এরপর রাত ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন স্টেশন থেকে আবার বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথমে বাংলায় এবং পরে ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ঘোষণাটি পাঠ করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে।

রাত ১০টায় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ইংরেজিতে একটি আবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার এবং মুক্তিকামী জনগণকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়।

পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব: ২৬ মার্চ সারা দিন ও রাতে সান্ধ্য আইন জারি করে পাকিস্তানি সেনারা দলে দলে রাস্তায় নেমে ভবন, বস্তি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি আক্রমণ করে। গোলাগুলি করে এবং আগুন লাগিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়। সকালে এলিফ্যান্ট রোডে আগরতলা মামলার ২ নম্বর অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার পর তাঁর লাশ নিয়ে যায়।

সেনারা দুপুরে পুরান ঢাকার হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণ করে। সেনাবাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গোলাগুলি করে লোক হত্যা করে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চলে।

নগরীর বিভিন্ন স্থানে ২৬ মার্চ দিনরাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনারা শত শত লাশ মাটি চাপা দেয়। পুরান ঢাকার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গা নদীতে।

বিদেশি সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রাখা হয়। তাঁদের বাইরে আসতে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং কয়েকটি পত্রিকা অফিস পাকিস্তানি সেনারা ট্যাঙ্কের গোলায় ধ্বংস করে। নিউইয়র্ক টাইমস–এর ২৮ মার্চ সংখ্যা জানায়, দ্য পিপল অফিস পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে সাংবাদিকেরা এ দৃশ্য দেখেন।

দিনটি শুক্রবার হলেও ঢাকার কোনো মসজিদে এই দিন জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়নি।

অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ: চট্টগ্রামে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেনাদের নিয়ে বিদ্রোহ করেন। রেজিমেন্টের পাকিস্তানি ও অবাঙালিদের বন্দী করা হয়। জিয়াউর রহমান রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-পুলিশ-ইপিআর ও বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী নগরীর কয়েকটি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। রাতে কুমিরায় কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সেনারা মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

বগুড়ায় প্রতিরোধযুদ্ধ: সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ রংপুর থেকে এসে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়া শহর আক্রমণ করে। কালীতলাহাট পার হওয়ার পর অকস্মাৎ কিছু প্রতিরোধযোদ্ধা এসে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করে। প্রতিরোধ দমন করে পাকিস্তানি সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে চলে। বড়গোলায় তারা বড় প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ঝাউতলায় যুদ্ধে শহীদ হন আজাদ নামে এক প্রতিরোধযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে বগুড়ার মাটিতে আজাদই প্রথম শহীদ।

এদিনের যুদ্ধে আরও তিনজন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। তুমুল প্রতিরোধের মুখে দুপুর সাড়ে ১২টায় পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে শহর ছেড়ে সুবিলের (করতোয়ার একটি খাল) উত্তর পারে এক ডাকবাংলো ও মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। এরপর বগুড়া শহর পাকিস্তানি সেনা থেকে বেশ কিছুদিন মুক্ত থাকে।

ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ: রাত আটটায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচি থেকে বেতার ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে আবার সরকারের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন। তিনি ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ তিন সপ্তাহ ধরে আইনসংগত কর্তৃপক্ষকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করে সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছেন। তাঁরা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন, পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ও জাতির জনকের ছবির অবমাননা করেছেন এবং আইন অমান্য করে সমান্তরাল সরকার গঠনের প্রয়াস চালিয়েছেন। শেখ মুজিব দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছেন। এর শাস্তি তাঁকে অবশ্যই পেতে হবে।

ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, সেনাবাহিনীকে তিনি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সারা দেশে সব রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। নিষিদ্ধ করা হলো আওয়ামী লীগকে। প্রচারমাধ্যমের ওপরও সেন্সরশিপ বলবৎ করা হলো।

সূত্র: যে রাতে মুজিব বন্দী হলেন, জেড এ খান, ১৯৭১: শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন; উইটনেস টু সারেন্ডার, সিদ্দিক সালিক, ইউপিএল; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড; একটি জাতির জন্ম, জিয়াউর রহমান, দৈনিক বাংলা, ১৯৭২।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।