দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করবেন। সে সময় তিনি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি এবং কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আলোচনার বিষয় নিয়ে মুখপাত্র কিছু বলেননি। তবে দিল্লির কূটনৈতিক ও সামরিক মহল জানায়, এ মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হবে, সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রধান স্থান পাবে। তা ছাড়া বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এ বিপদ সম্পর্কে সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী কথা বলবেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক ১২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে এখন আপসের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, প্রায় এক কোটি মানুষ আজ শরণার্থী এবং কয়েক লাখ লোক নিহত।
দিল্লিতে এদিন ভারত–বাংলা মৈত্রী সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে নেওয়া একটি সিদ্ধান্তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আরও দেরি হলে সাম্প্রদায়িকতা বাড়বে এবং গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ভারত ও বাংলাদেশ—দুই জায়গাতেই প্রবল হয়ে উঠবে। ভারত–বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে ভারত সরকারের তিনজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন, মইনুল হক চৌধুরী ও সিদ্ধার্থ শংকর রায় এবং দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের আমজাদুল হক উপস্থিত ছিলেন।
পাকিস্তানি দূতের প্রত্যাবর্তন
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহসভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর শেষে এই দিন ঢাকা আসেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইউরোপের গণমাধ্যমগুলোতে একই সুরে এই প্রচার চলছে যে পূর্ব পাকিস্তানে একটা অঘটন ঘটে গেছে। পাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা দলটিকে ক্ষমতা না দিয়ে সেনাবাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জনগণের দাবি নস্যাৎ করতে চায়। তিনি বলেন, ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যা ঘটবার ঘটেছে। এখন যারা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাদের নেতার সঙ্গে আপস করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পাকিস্তানের একটি প্যাট্রল দলকে অ্যামবুশ করে। এতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৯ রাজপুত ব্যাটালিয়নের একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। পাকিস্তানি প্যাট্রল দলের কয়েকজন আহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার উশখাইল গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় একজন সহযোগীকে অভিনব কৌশলে শাস্তি দেয়। আবদুল হাকিম নামে পাকিস্তানি বাহিনীর ওই সহযোগী স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল ও তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। এদিন তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে বরপক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বরপক্ষের ছদ্মবেশে মিষ্টির হাঁড়িসহ তার বাড়িতে হাজির হন। বরপক্ষকে অভ্যর্থনা জানাতে আবদুল হাকিম বাড়ির বাইরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল ফেনীর ছাগলনাইয়ায় একটি সড়কে মাইন পুঁতে রাখে। সে মাইন বিস্ফোরণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার গোমতী নদীতে টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা জগন্নাথ দীঘিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য আরেকটি দল শালদায় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করে।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সাতক্ষীরা জেলার ভোমরায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দুজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ; সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও আট; পূর্বদেশ, ঢাকা, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান