বিজ্ঞাপন
default-image

দিল্লিতে ২২ সেপ্টেম্বর হঠাৎ ঘোষণা করা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি ১ অক্টোবর দিল্লিতে আসছেন। ২ অক্টোবর হ্যানয়ে যাওয়ার আগে তিনি দিল্লিতে এক দিনের যাত্রাবিরতি করবেন। বাংলাদেশ সংকটের প্রেক্ষাপটে পদগর্নির এই যাত্রাবিরতিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘবিষয়ক বিভাগের প্রধান এস কে জারাপকিন কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই এদিন হঠাৎ দিল্লিতে আসেন। পৌঁছেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যেসব বিষয় তোলা হবে, সেসব নিয়েই আলোচনা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ভারতে সফররত জাপানি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা এবং দেশটির প্রতিনিধি সভার বিদেশবিষয়ক কমিটির সভাপতি ওশিও সাকুরাউচি এই দিন দিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ শঙ্করকে জানান, জাপান বাংলাদেশের বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করবে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রতিশ্রুতি দেন, শরণার্থী সমস্যার সমাধানে জাপান সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য দেবে। জাপানি দলটি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকেও জাপানের মনোভাবের কথা জানায়।

দিল্লিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে চার দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষে ১৮টি দেশের ৩৫ জন প্রতিনিধি কলকাতায় এসে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেন। তবে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী তাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেননি। তাঁরা বাংলাদেশ মিশনেও যান।

জাদুকর পি সি সরকার (জুনিয়র) পূর্বপ্রতিশ্রুতিমতো দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে বাংলাদেশের জন্য ৫০ হাজার টাকা দেন। উত্তর ভারতের জাদু প্রদর্শনী থেকে এ অর্থ তিনি আয় করেন।

বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক নয়

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনের জন্য নবনির্বাচিত সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার ড. আদম মালিক এই দিন বলেন, তিনি বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে সাধারণ পরিষদে বিতর্কের পক্ষপাতী নন। কারণ, এ বিতর্কের শিগগির সমাধান হবে না। আদম মালিক পরিষদের সভাপতি হিসেবে এদিন প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তানকে একসঙ্গে বসিয়ে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য চাপ দেওয়া উচিত।

সুইডেনের লিবারেল পার্টির যুব শাখা লিবারেল ইয়ুথ লিগ বাংলাদেশের সমর্থনে দেশটিতে এদিন একটি অভিযান শুরু করে। চার দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে তারা এ আন্দোলন চালাবে বলে জানায়। ১. বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি, ২. জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন, ৩. বাংলাদেশে দমন-পীড়ন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে উন্নয়নমূলক কাজে সাহায্য বন্ধ রাখা, ৪. বাংলাদেশের শরণার্থীদের আরও বেশি করে সাহায্য দেওয়া।

স্বাধীনতাই একমাত্র কাম্য

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য দিতে মুজিবনগর থেকে নিউইয়র্কগামী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলের সদস্য আবুল ফতেহ এদিন দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের এখন স্বাধীনতাই একমাত্র কাম্য। বাংলাদেশ যে চারটি শর্ত দিয়েছে, সেগুলো মানলে তবেই রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব: ১. সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি, ২. সব পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার, ৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, ৪. বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দেওয়া। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে গণহত্যাও একটি আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ।

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভারতের মেঘালয় ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ শেষে চারটি নৌকায় বাংলাদেশে প্রবেশের পথে শালদানদী এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের আক্রমণ করে। সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি নৌকা ডুবে যায়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও একজন আহত হন।

৭ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কাটাখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবস্থানরত সেনা ও রাজাকারদের ওপর মর্টার আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কোটা নামে এলাকার ওপর হামলা করে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষতিসাধন করেন। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মেহেরপুরের গাংনীর তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করলে তাদের কয়েকজন হতাহত হয়।

পাকিস্তানের অপতৎপরতা

এপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ। তবে আদালত রায় স্থগিত রেখেছেন।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীনকে উপমহাদেশে শান্তি আনার চেষ্টায় বাদ দেওয়া চলবে না। তিনি ঘোষণা করেন, তাঁর দল পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনে অংশ নেবে। তিনি জানুয়ারির আগেই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, সাত ও আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান