ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় ১০ জুন বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্গতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। লোকসভার কয়েকজন সদস্য শরণার্থী ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে বলেন, কেন্দ্রীয় বাজেটে শরণার্থীদের জন্য মাত্র ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই টাকা যথেষ্ট নয়।
আলোচনায় ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবন বলেন, বাংলাদেশের জন্য ভারতও যে সাহায্য করতে পারে, এ অর্থ তারই প্রতীক। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকেও এ দায়িত্বের ভাগ নিতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে শরণার্থীরা যাতে সম্মানের সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে, সে জন্য সবার চেষ্টা করা উচিত।
আলোচনায় ভারতের ত্রাণ ও পুনর্বাসন উপমন্ত্রী বালগোবিন্দ ভার্মা লোকসভায় জানান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি—এই সাত দেশ শরণার্থীদের ত্রাণকাজে সাহায্য দিতে চেয়েছে। ফাও, ইউনিসেফ ও ইউএনএইচআর—জাতিসংঘের এই তিন সংস্থা এবং নরওয়ের শরণার্থী পরিষদ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতি ও ডেনমার্কের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা—এই চার বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও সাহায্য দেবে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে ৪ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৩০৯ জন কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার এবং তাদের মধ্যে ৮ হাজার ৮৩৪ জন মারা যাওয়ার খবর আসে।
শরণার্থীদের মধ্যে কলেরার মহামারি নিয়ে রাজ্যসভার সদস্য এন জি গোরে এবং ভূপেশ গুপ্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। ভূপেশ দত্ত মহামারির কবল থেকে শরণার্থীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসতে কেন্দ্র ও সব রাজ্যকে আহ্বান জানান।
পশ্চিমবঙ্গের ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন এদিন শরণার্থীদের সাহায্যে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির কাছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৯ টাকার একটি চেক দেয়। পশ্চিমবঙ্গের
২৮২টি প্রেক্ষাগৃহের এক দিনের টিকিট বিক্রি থেকে এই অর্থ সংগৃহীত হয়। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সভাপতি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের হাতে চেকটি দেওয়া হয়।
শরণার্থীদের চিকিৎসার্থে লন্ডন থেকে ওয়ার অন ওয়ান্টের পাঠানো ৪০ শয্যার ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের সরঞ্জাম এদিন উড়োজাহাজে কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এই হাসপাতালে একজন ভারতীয়সহ চারজন চিকিৎসক ও ১১ জন নার্স কাজ করবেন। শরণার্থীদের জন্য আরও তিনটি উড়োজাহাজে এদিন ত্রাণসামগ্রী কলকাতায় পৌঁছায়।
আরও যোগাযোগ, আরও সাহায্য
বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থীদের বিষয়ে জানাতে বিভিন্ন দেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াল্টার শিলের সঙ্গে আলোচনা করেন।
পশ্চিম জার্মানি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ১.২৫ কোটি রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) সাহায্য মঞ্জুর করে।
সামরিক ঘোষণা, মুক্তিবাহিনীর অভিযান
সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাওয়া যেকোনো নাগরিক দেশে ফিরে এলে তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।
প্রদেশের অবস্থা স্বাভাবিক দাবি করে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১০ জুন সান্ধ্য আইন পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় একটি দল ফেনীর বিলোনিয়ায় মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটিতে দুই দফা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা দুবারই তা প্রতিহত করেন।
পিরোজপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মঠবাড়িয়া থেকে ১০ জন ছাত্রকে ধরে এনে বলেশ্বর নদের তীরে গুলি করে হত্যা করে।
মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। একদল মুক্তিযোদ্ধা হেয়াঁকু-রামগড় সড়কে রামগড়গামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ির ওপর আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু সময় যুদ্ধ করার পর পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলাদল সাতক্ষীরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে আক্রমণ করে তাদের পর্যুদস্ত করে। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল বসন্তপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান।
মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং সিলেটের জৈন্তাপুরে ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করেন।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, চার ও নয়; ইত্তেফাক, ১১ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১১ ও ১২ জুন ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান