বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৫ জুন সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং শরণার্থী–সংকট নিয়ে তিন ঘণ্টা বিতর্কের উত্তর দেন। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিলে সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু রাজনৈতিক মীমাংসার আশা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান মানে বাংলাদেশের সংহার নয়। গণতন্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা লড়ছে, তাদের বিনাশ করা যায় না। যারা আজ দমিত, রাজনৈতিক সমাধান তাদের সঙ্গেই করতে হবে।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শরণার্থীদের ভারতে চিরকাল রাখার ইচ্ছা সরকারের নেই। কিন্তু জোর করে তাদের বাংলাদেশে অগ্নিকুণ্ডের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। সদস্যদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে ভারতীয় দূতেরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাননি। তাঁরা গেছেন বিশ্বসমাজকে সচেতন করতে।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদদের নেতা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে সাতজনের একটি বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে দিল্লির শিক্ষাবিদদের ওয়াকিবহাল করার জন্য আলীগড় থেকে দিল্লি যান। প্রতিনিধিদলের সাতজনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশ এবং চারজন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ ও বয়রা সীমান্তে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ–দুর্দশা নিজ চোখে দেখেন। বনগাঁয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তাঁকে একটি স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহৃত না হলে শরণার্থীদের ঘরে ফেরার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।

শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে ফেরার পরে প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান সাংবাদিকদের বলেন, শরণার্থীরা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে আদৌ নিরাপদ থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। তবে শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি শিগগিরই হয়তো তৈরি হবে, যদিও এর কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। অনুকূল পরিবেশ পাকিস্তানকেই সৃষ্টি করতে হবে। বাইরের কোনো শক্তির পক্ষে এ কাজ কষ্টসাধ্য।

সর্বভারতীয় সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কেন্দ্রের উচিত শরণার্থীদের দায়িত্ব গ্রহণে সব রাজ্যকে বাধ্য করা। কারণ, এটি একটি জাতীয় সংকট।

জাতিসংঘে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংহ বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে এদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন। বৈঠকের পর সরদার শরণ সিং সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির মৌলিক বিষয়গুলো এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ভারত যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তা তিনি মহাসচিবের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন। সমস্যাটি শুধু ভারত-পাকিস্তানের নয়, বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে বাংলাদেশের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় কুয়ালালামপুরে বলেন, যুক্তিগ্রাহ্য সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা না হলে ভারত নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তিনি আরও বলেন, পূর্ব বাংলায় দ্রুত প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান চাই। সেখানকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্নিনান্দ ই মার্কোস ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠির জবাবে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিবাদের ফলে সেখানকার বাঙালি জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় ফিলিপাইন সরকার ও জনগণ গভীরভাবে মর্মাহত।

দ্য ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ–এ ‘পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ’ শিরোনামে সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি জনতার ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের খবর ফাঁস হচ্ছে। একের পর এক পাওয়া তথ্য-প্রমাণে দেখা যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা ঠান্ডা মাথায় বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী, বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করছে, যারা প্রকৃতপক্ষে একটি স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেখতে ঢাকায় আসেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন মিসেস জিল নাইট, জেমস কিলফেডার ও জেমস টিন। বিশ্বব্যাংকের এশিয়া বিভাগের পরিচালক পিটার কারগিল এবং আইএমএফের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের পরিচালক গাম্বারও রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন।

লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে তাঁর বক্তব্যের যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, তা ভ্রান্ত। এ বিষয়ে একমাত্র প্রেসিডেন্টই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ইসলামাবাদে সরকারি সূত্র জানায়, চীন পাকিস্তানকে এক বছরের বেশি সময়ের জন্য ৭ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য সাহায্য দেবে। এ–সংক্রান্ত ঋণ চুক্তিটি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে নিজেদের স্বার্থে আপত্তিকর পুস্তক–পুস্তিকা, পোস্টার ও প্রচারপত্র নিকটবর্তী সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আপত্তিকর পুস্তকের একটি তালিকাও কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করে।

বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ

শাহাজিবাজারের কাছে একটি রেলসেতুতে মুক্তিযোদ্ধারা সেনাবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। এতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত ও ট্রেনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়ার একটি দল সুনামগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর ধর্মপাশা ঘাঁটিতে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। ধর্মপাশা সদর দখল করে তারা ধর্মপাশা বাজার পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই।

এ ছাড়া ভূরুঙ্গামারী, বৃহত্তর কুষ্টিয়ার হিজলী ও বৈদ্যনাথতলা, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, যশোরের বেনাপোলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, চার ও সাত; ইত্তেফাকআজাদ, ১৬ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১৬ ও ১৭ জুন ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান