বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যুক্তরাজ্যে গঠিত অ্যাকশন কমিটির লন্ডন শাখা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব ভ্রমণরত ভারতীয় সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্মানে ৪ জুন লন্ডনে এক চা-চক্রের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অ্যাকশন কমিটির পক্ষে গাউস খান এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষে শেখ আবদুল মান্নান বক্তব্য দেন।

সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশের ঘটনাবলি জানাতে লন্ডনে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমনওয়েলথ রিলেশনস অফিসের ভারত উপমহাদেশের সমস্যা সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল অ্যান্থনি কেরশার।

যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালি নারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে মিছিলের আয়োজন করে। প্রায় ২০০ নারী ও শিশু সেন্ট জেমস পার্ক থেকে মিছিল করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে যায়। অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যার অবসান এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিসংবলিত পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড হাতে শাড়ি পরা নারীদের মিছিল পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

মহিলা সমিতির সভাপতি জেবুন্নেসা বসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে একটি স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং ইয়াহিয়া সরকারকে দেওয়া সাহায্য অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে অনুরোধ জানানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর হিউবার্ট হামফ্রে ওয়াশিংটনে বলেন, পূর্ব বাংলায় তিন কোটি লোক অনাহারের মুখে। নিক্সন প্রশাসনের মন্থরতার সমালোচনা করে তিনি সেখানে অবিলম্বে সাহায্য দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তান ক্ষুরের মতো ধারালো হয়ে উঠছে। সেটিকে ভোঁতা করে দেওয়ার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোনো ফল হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, আগের বছর ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণকার্য চালাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারকে দেওয়া ৫০টি মোটরবোটে পাকিস্তানি সেনারা চলাচল করছে। কাগজে তার ছবি বেরিয়েছে। তাঁরা এসবের প্রমাণাদি চেয়েছেন। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসকেও এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। চার্লস ব্রে আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের খাবার ও চিকিৎসার জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে সাহায্য আরও বাড়ানো হবে। ভারত সরকারের অনুরোধে শরণার্থীদের স্থানান্তরের জন্য ভারতে সি ১৩০ সামরিক বিমান পাঠানো হচ্ছে।

এই দিন যুগোস্লাভিয়া সরকার এবং ওআইসির মহাসচিব টুংকু আবদুল রহমান এই দিন বাংলাদেশের শরণার্থী এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় সহানুভূতি জানান। টুংকু আবদুল রহমান বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় মানুষদের সাহায্যের জন্য ওআইসি মুসলিম দেশগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে। এর চেয়ে বেশি তিনি আর কিছু জানাননি। জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নেপাল শরণার্থীদের জন্য ২৫ হাজার নেপালি মুদ্রা পাঠাবে বলে জানায়।

পশ্চিমা চিন্তাধারায় সমাধান নেই

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি এম আমীর-উল ইসলাম ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ৪ জুন বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো মীমাংসা করতে গেলে সেখানকার জনগণের নৈতিক ও আইনগত অধিকারকে স্বীকার করতে হবে। দিল্লি প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিল্লি সফররত বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের তিন সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার, নূরজাহান মুরশিদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনও উপস্থিত ছিলেন।

এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চিন্তাধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক মীমাংসায় সম্মত নয়। তিনি আরও বলেন, সামরিক বা রাজনৈতিক মীমাংসা নয়, প্রয়োজন নৈতিক ও আইনি অধিকার। এ যুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জয় সুনিশ্চিত।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র জয় বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ ব্যাপারে অন্য কোনো ফয়সালার সুযোগ নেই।

ভারতে বাংলাদেশ

ভারতের লোকসভায় এই দিন বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিয়ে বিতর্ক হয়। কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, শরণার্থীদের দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। শরণার্থীস্রোতের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় নিয়ে সরকার ভাবছে।

বনগাঁ ও দমদমে শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে এসে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বিদেশবিষয়ক কমিটির এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স উপকমিটির চেয়ারম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পূর্ব বাংলায় ব্যাপক গণহত্যা ও লাখ লাখ মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের তথ্য এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তুলে ধরবেন।
সিকিম সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য তহবিলের জন্য তিন লাখ টাকার চেক পাঠায়। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা প্রশাসন এই দিন জানায়, নদীয়া জেলায় গতকাল পর্যন্ত কলেরায় আক্রান্ত ২ হাজার ৫৫০ জন শরণার্থী মারা গেছে।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ইসমত কিতানি এই দিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মুহাম্মদ।

পাকিস্তান পিপলস পার্টি নেতা মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি ও আবদুল হাফিজ কারদার ঢাকা থেকে ৪ জুন পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে বলেন, আওয়ামী লীগ ও অন্য বাম দলগুলো না থাকায় এটিই পিপিপির জন্য পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার উপযুক্ত সময়।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশের দলত্যাগী সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলে, স্বেচ্ছায় এলে সহানুভূতি প্রদর্শন করা হবে।

একটি পাকিস্তানি সেনাদল স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে ৪ জুন রাতে নাটোরের ছাতনীসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে হানা দিয়ে নিদ্রিত লোকদের ঘুম থেকে তুলে পিছমোড়া করে বাঁধে। প্রায় ৫০০ গ্রামবাসীকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে।

পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় ঝালকাঠির পাঁজিপুথিপাড়ায় অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদানদীর দক্ষিণে বাগড়া বাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এ আক্রমণের তিন ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধারা আবার সেখানে আক্রমণ চালিয়ে অক্ষত অবস্থায় ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।

মুক্তিবাহিনীর একটি দল কুমিল্লার রাজাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি করে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও সাত; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; পূর্বদেশ ও দৈনিক পাকিস্তান, ৫ ও ৬ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ৫ ও ৬ জুন ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান