বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ১৬ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি পাঠানোর বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতবিনিময় হয়। যদিও প্রতিনিধিদের তালিকা এ দিন চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু গোপন রাখা হয়।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ দিন বলেন, ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে একনায়কত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সে দিন সামরিক একনায়ক আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সময় বহু যুবক ঢাকার রাস্তায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশে পাকিস্তানি মিশনে নিয়োজিত বাঙালি কূটনীতিকদের কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সম্পর্কচ্ছেদ করবেন বলে প্রকাশিত খবর এ দিন বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সমর্থন করেন। তিনি বলেন, সিদ্ধান্তটি এ মাসের শেষ সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জোরদার করার উদ্দেশ্যে ছাত্রসংগঠন, রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য পাঁচটি দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে পরামর্শক কমিটি গঠনকে তিনি স্বাগত জানান।

সামরিক ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুর বিচার শেষ

পাকিস্তান সরকারনিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ইমরোজ ১৬ সেপ্টেম্বর জানায়, বিলুপ্ত ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের কাজ শেষ হয়েছে। তাঁর বিচারের জন্য গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে শিগগিরই প্রতিবেদন পেশ করবে। তবে বঙ্গবন্ধুকে কোথায় আটক রাখা হয়েছে, পত্রিকায় তা প্রকাশ করা হয়নি।

২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন কায়েমপুরে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্প আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৬ জন আহত হন।

৭ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা মর্টারের সাহায্যে সারদায় আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, পুলিশ ও রাজাকার হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কানপুরে পাকিস্তানি অবস্থানে অভিযান চালান।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সাতক্ষীরার ভোমরায় পাকিস্তানি অবস্থানে কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।

ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ স্টেশনের অদূরে পাকিস্তানি চরদের নাশকতায় ধর্মনগরগামী একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। করিমগঞ্জ শহরের দুই মাইল দূরে ডিনামাইট বিস্ফোরণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ১ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ১১ জন সামরিক বাহিনীর লোক। ভারতের সরকারি সূত্র দাবি করে, এর আগেও পাকিস্তানি চরেরা সীমান্ত এলাকায় নাশকতা চালায়। ১৬ আগস্ট রাতে আসামের কাছাড় জেলায় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের শিলচর-করিমগঞ্জ সেকশনের ডাঙ্গা-চরগোলা স্টেশনের মধ্যবর্তী এক স্থানে মালগাড়ি উড়িয়ে দেয়।

কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশ

কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে এ দিন আলোচ্যসূচি ছাপিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পায়। অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য তামিলনাড়ু বিধানসভার স্পিকার কে এ মথিয়ানগন বলেন, বাংলাদেশের নিরীহ লোকদের হত্যা বন্ধ করার জন্য কমনওয়েলথভুক্ত দেশ এবং অন্যান্য সংস্থার সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

পাকিস্তানে সংসদ না থাকায় এই সম্মেলনে পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। মালয়েশিয়ার স্থানীয় সংবাদপত্রে এ দিন দেশটিতে নিয়োজিত পাকিস্তানের হাইকমিশনারের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা করা অনুচিত হয়েছে। কারণ, এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য এস এস গুরুপদস্বামী তাঁর এ বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে কি না, সম্মেলনের প্রতিনিধিরাই তা ঠিক করবেন।

ডেনমার্ক সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এ দিন সকালে জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে যোগদানের জন্য মনোনীত ডেনিশ প্রতিনিধিদলের নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাতিসংঘে অন্য দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি সহায়তা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন।

যুক্তরাজ্যের স্কারবারা শহরে উদারনৈতিক দলের বার্ষিক সম্মেলনে পার্লামেন্ট সদস্য জন পারডো এক প্রস্তাবে অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানান। প্রস্তাবে বলা হয়, ৬০ দিনের মধ্যে এ দাবি পূরণ না করা হলে ব্রিটিশ সরকারের একটি কমনওয়েলথ সম্মেলন আহ্বান করে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করা উচিত।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, সাত ও আট; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান