বিজ্ঞাপন

সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ২২ মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের ষষ্ঠ বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও যোগ দেন।

default-image

প্রেসিডেন্টের ভবন এলাকায় ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটে। প্রধান ফটকের অদূরে জনতা শেখ মুজিবের সমর্থনে ও ভুট্টোর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন বঙ্গবন্ধুর এক ঘণ্টা আগে। ভুট্টো সন্ধ্যায় আবার নিজের উপদেষ্টাদের নিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টোর বৈঠক চলাকালেই ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনের মুখপাত্রের ঘোষণায় বলা হয়, পাকিস্তানের দুই অংশের নেতাদের মধ্যে আলোচনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের পরিবেশ সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য প্রেসিডেন্ট এ অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বৈঠক শেষে বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, বাঙালি আন্দোলনে আছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর নির্ধারিত বৈঠকে ভুট্টোও ছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পরের বৈঠক কবে হবে, তা আমি জানি না। আগামীকাল বা পরশু হতে পারে। তবে আজ বা আগামীকাল আমার দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে আরেক দফা বৈঠক হতে পারে।’

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবেন না। সে অনুসারেই প্রেসিডেন্ট পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে মানুষের ঢল: অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম এই দিনেও বিভিন্ন সংগঠনের সভা-সমাবেশ-মিছিল চলতেই থাকে। পল্টন ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ হয়। সেখানে বক্তারা বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে, তাতে সাবেক সৈনিকেরা আর সাবেক হিসেবে বসে থাকতে পারে না।
এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদ। তাতে বক্তব্য দেন কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানীসহ অন্যরা। সাবেক বাঙালি সেনাদের বক্তব্য শোনার জন্য পল্টন ময়দানে বিপুল জনসমাগম ঘটে। সভা শেষে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনারা কুচকাওয়াজ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ও বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান।
সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথ ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর। সব মিছিল আর শোভাযাত্রার গন্তব্য ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশে বেশ কয়েকবার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘সাত কোটি মানুষের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রামে আমরা অবশ্যই জয়ী হব।’

ভুট্টোর হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন: রাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের লাউঞ্জে সাংবাদিকদের বলেন, প্রেসিডেন্ট ও আওয়ামী লীগ প্রধান একটি সাধারণ মতৈক্যে পৌঁছেছেন। তবে পিপলস পার্টির কাছে এ মতৈক্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারে না।

ভুট্টো জোর দিয়ে বলেন, দেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে অবশ্যই সমঝোতা ও মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। পিপলস পার্টি এ কারণেই আওয়ামী লীগের চার দফা পূর্বশর্ত বিবেচনা করছে এবং স্থায়ী ব্যবস্থার কথা মনে রেখে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা চিন্তাভাবনা করছে।

রাতে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ খান মোহাম্মদ দৌলতানা, ওয়ালি ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান, ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও সর্দার শওকত হায়াত খান এবং জমিয়তে উলামায়ের মহাসচিব মাওলানা মুফতি মাহমুদ প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। তাঁরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠক করেন। গভীর রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের এই নেতারা এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন।
অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য এদিন মুসলিম লীগ সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান ও জমিয়তে উলামায়ের প্রধান মাওলানা শাহ আহমদ নুরানিকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান।


সূত্র: ইত্তেফাক, পূর্বদেশ ও সংবাদ, ২৩ মার্চ ১৯৭১