যশোর সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার পর ১১ ডিসেম্বর যশোর শহরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশের চারটি রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল চারটি হলো মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম।
এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে পৌঁছালে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানায় বিপুলসংখ্যক মানুষ। তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন: ১. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। ২. ফেলে যাওয়া জমি ও দোকান ২৫ মার্চের আগের মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। চাষ হয়ে থাকলে চাষি বর্গাদার হিসেবে অর্ধেক ফলন পাবেন। ৩. যেকোনো ধর্মের যেকোনো নাগরিকের ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি করলে কঠোর সাজা দেওয়া হবে।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে তাঁর দলের সদস্য ও সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী এবং অন্য দল ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একযোগে স্বাধীনতাসংগ্রামকে জোরদার করে তোলার নির্দেশ দেন।
পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের আবেদন
জাতিসংঘের একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশে নিয়োজিত একদল জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চেয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রমের ফরাসি প্রধান পল মার্ক অঁরির মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চান। অঁরি জাতিসংঘের মহাসচিবকে বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন। তবে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি মহাসচিবকে এ বার্তা গ্রাহ্য না করার অনুরোধ জানান।
কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং করপোরেশন জানায়, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু অনুরোধে কান না দিতে ইয়াহিয়া খানের বার্তা এলে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা, ঢাকা জানান, পূর্ববঙ্গের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নির্ধারণের উদ্দেশ্য জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলোচনার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করেন, তা নিয়ে ইয়াহিয়া খান আপত্তি জানিয়েছেন।
ঢাকায় চারদিক যৌথ বাহিনী কার্যত ঘিরে ফেলেছে। আকাশ ও জলপথে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ। বহু জায়গায় আত্মসমর্পণের পালা শুরু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জামালপুরে ৬০০, লাকসামে ৪৫০ এবং মেঘনার পুবে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৮০০ পাকিস্তানি যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ এক বেতার ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পালানোর পথ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চীন যুদ্ধে জড়াবে না
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, বেইজিংয়ের কূটনৈতিক মহল বলছে, চীন শুধু জাতিসংঘের ভেতরেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাবে। সেনা পাঠিয়ে ভারত আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল সমস্যা না মেটা পর্যন্ত এবং এ আলোচনায় বাংলাদেশকে না ডাকা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অবাস্তব।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ডেমোক্র্যাট–দলীয় সিনেটর ফ্র্যাংক চার্চ ওয়াশিংটনে বলেন, পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য দেওয়ার জন্য পাকিস্তান অনুরোধ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশেষ বিবেচনা করছেন।
ঢাকায় এখন শুধু অপেক্ষা
যৌথ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বলা হয়, জামালপুর ও ময়মনসিংহের পতনের পর ঢাকার সংকট ঘনীভূত। উত্তর–পূর্বে যৌথ বাহিনী মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকা অভিমুখী। অপেক্ষা এখন যৌথ বাহিনীর ঢাকা দখলের লড়াইয়ের।
যৌথ বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মুখে রাতে তুমুল যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া শহর মুক্ত হয়। আগের দিন যৌথ বাহিনী ঝিনাইদহ থেকে ট্যাংক নিয়ে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর ফাঁদে পড়েছিল। তখন শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এরপর ভারতীয় বিমানের হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হতাহতদের ফেলে সকালে পালিয়ে যায়। ঈশ্বরদী থেকে পালানোর সময় পাকিস্তানি সেনারা হার্ডিঞ্জ রেলসেতুর একাংশের গার্ডার ধ্বংস করে। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ২০০ জন শহীদ হন।
যশোর থেকে ঢাকা অভিমুখী যৌথ বাহিনী মাগুরা শহর পেরিয়ে মধুমতি নদীর তীরে পৌঁছে যায়। নদীর ওপারে পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি গেড়ে তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। খুলনা অঞ্চলে যৌথ বাহিনী এদিন খুলনা জেলা শহরের ১০ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়।
যৌথ বাহিনীর আরেক অংশ ভৈরব বাজারের দক্ষিণে সড়কপথ ধরে এগিয়ে যায় ঢাকার দিকে। চাঁদপুর ও কুমিল্লার মধ্যবর্তী লাকসামে ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও একটি বালুচ রেজিমেন্টের প্রায় ৪০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
ময়মনসিংহ, জামালপুর, নোয়াখালী, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, দুর্গাদিঘি প্রভৃতি স্থান এদিন মুক্ত হয়। ভোরের আগেই পাকিস্তানি সেনারা ময়মনসিংহ শহর থেকে পালিয়ে যায়। মুক্ত হয় ময়মনসিংহ শহর। পালানোর সময় পাকিস্তানিরা শম্ভুগঞ্জ সেতু ধ্বংস করে। চাঁদপুরের মতলব এদিন মুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা বেশির ভাগ স্থানেই যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেনি। বাধা দেওয়ার চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত তারা হয় পালিয়ে যায়, নয় আত্মসমর্পণ করে। গত ২৪ ঘণ্টায় আত্মসমর্পণ করে প্রায় দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা।
ঢাকা থেকে এদিন বিদেশি নাগরিকদের অপসারণের কথা থাকলেও পাকিস্তানিদের বাধার মুখে সেটি স্থগিত হয়ে যায়। আগে থেকে কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ দুটি ব্রিটিশ ও একটি কানাডীয় বিমানকে ঢাকা বিমানবন্দরে নামতে দেয়নি। এ সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ বন্ধ রেখেছিল।
সূত্র: স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল পাবলিকেশন্স, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য সানডে টেলিগ্রাফ, ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান