বিজ্ঞাপন
default-image

আগের দিনের ছড়ানো গুজবকে সত্যি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বিকেলে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে স্বাগত জানান। কোনো সাংবাদিক বা বাঙালিকে বিমানবন্দরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) জুলফিকার আলী ভুট্টো আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কেন্দ্রে একটি কোয়ালিশন সরকারের দাবি জানান।

এই দিনও দেশজুড়ে পূর্ণ কর্মবিরতি চলে। ভবনে ভবনে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকাও তোলা হয়। দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সামরিক নির্দেশ উপেক্ষা করে কর্মস্থলে যোগ দেননি। তাঁরা নাখালপাড়ায় একটি সভা করেন। সভাশেষে রাজপথে বের করেন বিক্ষোভ মিছিল।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে জনগণ অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে। ১৪ মার্চ যেসব নির্দেশ জারি করা হয়েছে, তিনি তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা মেনে চলার অনুরোধ জানান।

সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকেরা সমাবেশ-শোভাযাত্রা করেন। সন্ধ্যায় বেতার-টিভির শিল্পীরা সেখানে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। বিকেলে তোপখানা রোডে সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় নারী সমাবেশ। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা ট্রাকে চড়ে নগরীর নানা স্থানে গণসংগীত ও পথনাটক পরিবেশন করেন।

নতুন সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ছাত্র জমায়েত করে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

রাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত চেকপোস্ট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। বাংলা থেকে অর্থ ও সম্পদ পাচার বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত চেকপোস্টের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ায় প্রত্যাহার করা হয়। তবে কোনোক্রমেই যেন সম্পদ পাচার হতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখার অনুরোধ জানানো হয়।

খেতাব বর্জন: দেশজুড়ে সরকারি খেতাব বর্জন করতে শুরু করেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। দৈনিক পাকিস্তান-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন তাঁর দুই খেতাব ‘সিতারা-এ-খিদমত’ ও ‘সিতারা-এ-ইমতিয়াজ’ বর্জন করেন। নাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীও পরিত্যাগ করেন তাঁর ‘সিতারা-এ-ইমতিয়াজ’ খেতাব। নাটোর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডাক্তার শেখ মোবারক হোসেন তাঁর ‘তমঘা-এ-কায়েদে আজম’ খেতাব বর্জন করেন।

ভুট্টোর দাবি: করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো নতুন দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। তাঁর দাবি, কেন্দ্রে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে অবশ্যই তা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে করতে হবে। দেশ শাসনের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ইচ্ছার মূল্য দিতে হবে।

ভুট্টোর নতুন দাবিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। প্রবীণ রাজনীতিক আবুল হাশিম বলেন, জাতীয় পরিষদে ভুট্টোর স্থান বিরোধী দলের আসনে। তাঁর কথামতো প্রেসিডেন্ট চললে পাকিস্তানের বিভক্তি অনিবার্য। ঢাকায় পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন বলেন, একই পরিষদে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থাকতে পারে না। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগই একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।

করাচিতে এক সভায় কয়েকজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা বলেন, ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে অনেক কথাই বলছেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন তাঁর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এই অঞ্চলে ৩৮ শতাংশ ভোটও পায়নি। ক্ষমতা লাভের জন্য আওয়ামী লীগই একমাত্র দল।

করাচিতে জমিয়তে ওলামায়ের মহাসচিব মাওলানা মুফতি মাহমুদ পিপিপি প্রধানের প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, দেশে দুটি নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মাত্র একটি; আর সেটি আওয়ামী লীগ। তাই শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। ভুট্টোর দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক।

সূত্র: ইত্তেফাক ও দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ মার্চ ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।