বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতে সফররত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য টমাস জামিসন ১৭ মে দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকার ছয় মাসের সাহায্য চেয়েছে। ভারত সরকারের বিশ্বাস, ছয় মাসের মধ্যে শরণার্থীদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

শরণার্থী বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দিল্লিতে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। বৈঠকে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ভারত ছয়
মাসের জন্য সাহায্য চেয়েছে। তবে কিসের ভিত্তিতে ভারত ছয় মাসের মধ্যে সমস্যাটি মোকাবিলা করবে, সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেননি।

জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে ভারত জানায়, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের (আপাতত সংখ্যা ৩০ লাখ ধরে) ছয় মাস পর্যন্ত সাহায্য দিতে ২০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।

জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন এই দিন জাতিসংঘের সামাজিক কমিটির বৈঠকে বলেন, ভারতে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর সমস্যা কেবল ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা ভবনে শরণার্থী সমস্যা এবং ত্রাণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভার সাবকমিটির জরুরি বৈঠকে কেন্দ্রের কাছে পাঠানোর জন্য একটি চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়। দ্রুত পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার জন্য রাজ্যের তিনজন মন্ত্রী ২০ মে দিল্লি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় জানান, শরণার্থীদের নিয়ে ১৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থীদের অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভাবছে।

নরওয়ে রেডক্রসের প্রতিনিধি ফারে ওটারসন কলকাতায় জানান, আহত ও পীড়িত শরণার্থীদের চিকিৎসায় সহায়তার জন্য নরওয়ে থেকে একদল চিকিৎসক ও নার্স শিগগির পশ্চিমবঙ্গে আসবেন।

ভারতের লক্ষ্ণৌতে ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে জনমত তৈরির লক্ষ্যে আগামী ৮ জুন সংখ্যালঘুদের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য কে ডি মালব্যকে সভাপতি এবং নব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাফরকে সাধারণ সম্পাদক করে কনভেনশনের জন্য একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়।

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প এদিন দেশটির সংসদে জানান, ভারতের হাইকমিশনার অশোক লালকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সহায়তা করতে কানাডা প্রস্তুত।

পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অটো উইনজার বার্লিনে বলেন, ভারতের হাইকমিশনার জি সি আজমানি পূর্ব জার্মানির সরকারের কাছে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য সাহায্য ও সমর্থন চেয়ে অনুরোধ জানালে তিনি তাঁকে এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁরা শরণার্থীদের সব রকম মানবিক সাহায্য দিতে প্রস্তুত।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও বিশেষ দূত জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে পাকিস্তানের ভাষ্য জানান। তিনি জাতিসংঘের কাছে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্যের পাশাপাশি সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জলযান চেয়েছেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন এক ঘোষণায় অনুপ্রবেশকারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকলাপ বন্ধে সরকারকে সহযোগিতা করতে জনসাধারণের প্রতি নির্দেশ জারি করে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এদিন উপসামরিক কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেন। এই ক্ষমতাবলে তাঁরা যেকোনো ব্যক্তিকে আটক করে হাজতে পাঠানো, গ্রেপ্তারসহ অপরাধের তদন্ত করতে পারবেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত কোনো আপত্তি উত্থাপন করা যাবে না।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মেজর জেনারেল (অব.) ওমরাহ খান এদিন ঢাকায় একাধিক ঘরোয়া সভায় বলেন, দেশে এখন দুটি দল—পাকিস্তানপন্থী আর পাকিস্তানবিরোধী। পাকিস্তানবিরোধীদের খুঁজে বের করতে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার আবেদন জানান তিনি। গোলাম আযম, খাজা খয়েরুদ্দিন ও মেজর (অব.) আফসার উদ্দিন প্রমুখ সভায় বক্তৃতা করেন।

সূত্র: পূর্বদেশ, ১৮ মে ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৮ ও ১৯ মে ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান