বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৮ জুলাই হঠাৎ বিকেলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় আসেন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যে হঠাৎ তাঁর কলকাতা আগমনে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মানেকশ ফোর্ট উইলিয়ামে দীর্ঘ বৈঠক শেষে রাতে সরাসরি রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করবেন বলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হুমকিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ এদিন মুজিবনগর থেকে একটি বিবৃতি দেন। শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন বন্ধ করে তাঁর জীবন রক্ষার জন্য তিনি জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে আবেদন জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বিচার করার আইনগত কোনো অধিকার ইয়াহিয়ার নেই।

মিশনের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ

সুইজারল্যান্ডের মধ্যস্থতায় কলকাতায় সাবেক পাকিস্তানি উপহাইকমিশনের কর্মীদের আনুগত্য প্রশ্নে গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ হয়। জিজ্ঞাসাবাদে প্রায় সবাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিচল আনুগত্যের কথা জানান। এই সংবাদে খন্দকার মোশতাক আহমদ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী ও মিশনের কর্মীদের অভিনন্দিত করেন।

সুইস মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ৬৭ জন কর্মীর মধ্যে ৬৪ জনই আলাদাভাবে জানান যে তাঁরা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না। তিনটি জায়গায় অতি গোপনে এ জিজ্ঞাসাবাদ হয়। সুইস দূতাবাসের কাউন্সেলর ড. বোনার্ড, সাবেক পাকিস্তানি উপহাইকমিশনার মেহেদি মাসুদ ও ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের যুগ্ম সচিব অশোক রায় এই জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত ছিলেন।

তবে দুজন অবাঙালি কর্মী পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একজন অসুস্থ অবস্থায় নিজ বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তাঁর বাড়িতে গেলে তিনিও পাকিস্তানে যেতে চান না বলে জানান।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রংমহলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ছিল আলোচনা, সংগীত ও নাট্য পরিবেশনা। এর উদ্বোধন করেন সত্যেন সেন। আলোচকেরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। সংগীত পর্বে একক ও সমবেত কণ্ঠে ১৫টি প্রতিরোধের গান পরিবেশিত হয়। পরিবেশন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মোট ১৬ জন শিল্পী। নাট্যানুষ্ঠানে পূর্ণেন্দু পাল রচিত ‘বিদ্রোহী বাংলা’য় অভিনয় করেন গণসংস্কৃতি সংঘের শিল্পীরা।

ব্রিটেনপ্রবাসী প্রায় দুই হাজার বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। তাঁরা লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে মিছিল করে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা দূতাবাসে প্রতিবাদপত্র দেন। মিছিলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা স্মারকলিপি নেন। চীনা দূতাবাসের দরজা বন্ধ থাকায় স্মারকলিপিটি তাদের ডাকবাক্সে জমা দেওয়া হয়।

ঢাকায় গেরিলা অভিযান

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) এলাকার গ্যানিজ এবং ভোগ বিপণিকেন্দ্রে বিকেলে একটি অভিযান পরিচালনা করে। অবাঙালি মালিকানাধীন এই দুই বিপণিকেন্দ্রে পাকিস্তান অনুগত পুলিশ ও রাজাকার অবস্থান করছিল। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড ও ফসফরাস বোমা নিক্ষেপ করলে দোকান দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া পুলিশ, রাজাকার ও দোকানের কয়েকজন কর্মচারী আহত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শালদানদী এলাকার মনোরা সেতুর দিকে একদল পাকিস্তানি সেনা অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা মর্টার ও কামানের সাহায্যে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন হতাহত হয়। তারা পিছু হটে মনোরা সেতুর উত্তরে অবস্থান নেয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক) নেতৃত্বে কসবার উত্তরে কাসিমপুর সেতুর কাছে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তারা অবস্থানটি ত্যাগ করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সুবেদার আবদুল ওহাবের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম) নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদলের বেশ ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

শরীয়তপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলাদল গোসাইরহাট থানার দামুদিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করলে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যায় এবং ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাঁচটি রাইফেল, একটি ওয়্যারলেস সেট ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

ময়মনসিংহে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন রাতে টেলিফোন লাইন কেটে দেয়।

বৃহত্তর রংপুর জেলার বড়খাতা ও চৌইলাদি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি বড় সংঘর্ষ হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, সাত ও এগারো; ইত্তেফাক, ১৯ ও ২০ জুলাই ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান