বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাজ্য সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১ নভেম্বর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম দেখা করেন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত আগের দিনের আলোচনার ধারাবাহিকতায় তাঁরা ঘণ্টাখানেক কথা বলেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পায়। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা শুরু করতে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করাতে যুক্তরাজ্য আরেকবার চেষ্টা করবে বলে ভারতকে আভাস দিয়েছে। তবে ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট করে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেই কেবল স্থায়ী মীমাংসা সম্ভব। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত থেকে সেনা অপসারণ করা হবে না।

ব্রিটেন এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে অর্থবহ আলোচনা ইসলামাবাদ ও শেখ মুজিবের মধ্যেই হতে পারে। এ বৈঠকের পর বাংলাদেশের দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজন যুক্তরাজ্য মেনে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনায় শেখ মুজিবের আশু মুক্তির দাবিও জানানো হয়।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে দুটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। অথচ বিশ্বের কিছু রাষ্ট্র ইসলামাবাদের এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সে দেশের মানুষেরাই নির্ধারণ করবেন। গত বছর যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিল, সেখানে আবার নির্বাচন নিছক প্রহসন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে যে মূলনীতি জড়িত, তা থেকে বিশ্ব দূরে থাকতে পারে না।

এর আগে ইন্দিরা গান্ধী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। সাংবাদিকদের তিনি প্রশ্ন করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে কি চার্চিল হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন? বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য উ থান্টের প্রস্তাব তিনি সরাসরি অগ্রাহ্য করেন।

চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবে

ইয়াহিয়া খান সাপ্তাহিক নিউজউইক-এর ১ নভেম্বর সংখ্যায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ আসন্ন। যুদ্ধ হলে চীন পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তিনি বলেন, খেয়ালখুশিমতো আমি তাঁকে মুক্তি দিতে পারি না।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা বাঙালি মাহমুদ আলী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি দেখে বোঝা যায় যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সন্নিকটে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীসংক্রান্ত উপকমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে যে সংকট চলছে, তা নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। পাকিস্তান সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নীতি পাল্টানো এবং শান্তি রক্ষার বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা উচিত। সংকটের জন্য তিনি পাকিস্তানকে দোষারোপ করেন। তিনি আরও বলেন, ভারতের শরণার্থীশিবিরগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ৩০০ শিশু মারা যাচ্ছে। নতুন বৈদেশিক সাহায্য বিলে কংগ্রেস কোনো অর্থ মঞ্জুর না করলে তিনি শরণার্থী ত্রাণের জন্য ২৫ কোটি ডলার মঞ্জুরের জন্য একটি বিল পেশ করবেন।

পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা

লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় ১ নভেম্বর প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাদের অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সেনারা। বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজস্ব সংবাদদাতার প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকায় একাধিক সরকারি ভবনে উপর্যুপরি গেরিলা আক্রমণ হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি রাজধানীর প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অবস্থিত। গেরিলা আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নিরাপত্তা খুঁটি তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানের (পিআইএ) বোয়িং বিমানগুলো এখন পথ ছেড়ে যথাসম্ভব জলপথের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে, বিমানের আলোকসংকেতও জ্বালানো হচ্ছে না।

২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল এ দিন দুটি আলাদা অভিযান চালায়। একটি দল সন্ধ্যায় কাকরাইলে একটি পেট্রলপাম্পে বোমা ছোড়ে। অন্য দলটি বেলা ১১টার দিকে শান্তিনগরে একটি ব্যাংকে অভিযান পরিচালনা করে।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে যশোরের ঝিকরগাছার গৌরপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালালে কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর তারা পালিয়ে যায়। এরপর ওই এলাকায় আর ফিরে আসেনি।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার অন্তর্গত গোলদড়িতে রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালান। প্রায় ১৮ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা পালিয়ে যায়।

মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বিমান দিয়েই পাকিস্তানি বিমান আক্রমণ প্রতিরোধ করবে; তবে অসামরিক ব্যক্তিদের যাতে ক্ষতি না হয়, সে জন্য সেনানিবাস ও পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোর ওপরই বোমা ফেলা হবে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর পাঁচ; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২ নভেম্বর ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২ ও ৩ নভেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান