বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের ঘটনাবলি জানাতে এবং ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের জন্য সাহায্য সংগ্রহে ছয়টি দেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ১৪ জুন কানাডার অটোয়ায় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল শার্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকের আগে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ব্যাপারে অবিলম্বে কিছু একটা করতে হবে। নইলে ভারতকে নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।

১৪ জুন কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া ভোজসভায় সরদার শরণ সিং বলেন, বাংলাদেশের বিষয়টি কেবলই ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়। পাশ্চাত্য দেশগুলো শরণার্থী সমস্যাই বড় করে দেখে আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সামনে এখন যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা শুধু টাকাপয়সা দিয়েই সুরাহা করা যাবে না।

ভোজসভায় কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল শার্প পূর্ব পাকিস্তানে শিগগিরই অসামরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত এবং দেশটির কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় এই দিন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদুল রাজাক হুসেনের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কুয়ালালামপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যথাসময়ে পূর্ব বাংলার শরণার্থী সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাতে ভারতকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এত বিরাট শরণার্থী সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এখন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগোষ্ঠীর।

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে

বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির একজন মুখপাত্র মুজিবনগরে এই দিন সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের একটি ফুটবল দলকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলার জন্য পাঠানো হবে। প্রদর্শনীতে ফুটবল খেলা থেকে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ব্যয় করা হবে।

ভারতের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেন্দ্র পাল সিং এদিন লোকসভায় বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সরকারের নৃশংস আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে চীন ভারতের প্রতি শত্রু মনোভাব অবলম্বন করেছে, ভারত তার প্রতিবাদ জানায়নি। তবে পূর্ব বাংলার ব্যাপারে ভারত সরকারের মনোভাব চীনের দূতকে জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান এদিন পাকিস্তান থেকে দিল্লি পৌঁছান। দিল্লিতে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে বৈঠক করেন।

ভারতের সংযুক্ত সমাজবাদী দলের নেতা রাজনারায়ণ বারানসিতে ১৪ জুন সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করাটা ভারত সরকারের বিরাট ভুল। এতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ ভুল সংশোধনের জন্য তিনি অনশন করতে সংকল্পবদ্ধ।

ভারত সরকার এদিন শরণার্থী শিবিরগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয় সামরিক কর্মকর্তাদের। এ জন্য তিনজন ব্রিগেডিয়ার, ২০ জন কর্নেলসহ শতাধিক সামরিক কর্মকর্তাকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংযুক্ত করা হয়। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের পশ্চিমবঙ্গের কার্যালয় থেকে ক্যাম্প পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দিয়ে তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের সীমান্ত এলাকা থেকে ভারতের অন্য রাজ্যে স্থানান্তরের জন্য এদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম বিমানটি কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। আরেকটি সোভিয়েত বিমান ১৫ জুন কলকাতায় আসবে। বিমান দুটি শরণার্থী পরিবহনের কাজ করবে।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এদিন করাচিতে বলেন, বর্ষা মৌসুমে সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের ফলে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার সম্পূর্ণ তৈরি। তিনি বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন সমাধানের আগে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তে কিছু সেতু উড়িয়ে দিয়েছে এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করছে।

ঢাকা পৌর কর্তৃপক্ষ হিন্দু ব্যক্তিদের নামে দেওয়া শহরের দুই শরও বেশি রাস্তা, গলি ও উপগলির নাম বদল করে নতুন নাম দেয়। লালমোহন পোদ্দার রোডের নাম হয় আবদুর করিম গজনবী রোড, হরিচরণ রোডের নাম হয় মোহাম্মদ বিন কাশেম রোড। এভাবে শাঁখারীবাজার হয়ে যায় গুলবদন, কিষান ব্যানার্জি হয় আলীবর্দী, নবীন চাঁদ হয় বখতিয়ার খিলজি আর কালীচরণ রোড হয় গাজী সালাউদ্দিন রোড।

পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল এদিন সিলেট জেলার বালাগঞ্জের আদিত্যপুর গ্রামে এসে পুরো গ্রাম ঘিরে রাখে। এরপর লাউডস্পিকারে ঘোষণা দিয়ে গ্রামের পুরুষদের আদিত্যপুর সরকারি স্কুলের সামনে সমবেত করে। পাকিস্তানি সেনারা সমবেত পুরুষদের বেঁধে গুলি চালালে ৬৩ জন নিহত হন। মৃতের ভান করে দুজন বেঁচে যান। এরপর পাকিস্তান সেনারা নারীদের ওপর অত্যাচার চালায়।

আরেক দল পাকিস্তানি সেনা সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দের ভদ্রঘাট গ্রাম ঘেরাও করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। হত্যা করে ১৯ জনকে। এটি ভদ্রঘাট ও ধামকোল গণহত্যা নামে পরিচিত হয়।

পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল কুমিল্লা থেকে চৌদ্দগ্রামের দিকে যাওয়ার পথে একদল মুক্তিযোদ্ধা নয়াবাজারের কাছে তাদের অ্যাম্বুশ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

গোপালগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর চলবল ঘাঁটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি দল মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট এই তিন দিক দিয়ে আক্রমণ চালায়। বান্দাবাড়ি খালের কাছে মুক্তিবাহিনীর হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মকবুল শহীদ হন এবং হেমায়েত আহত হন। এ যুদ্ধের পর হেমায়েত বাহিনী কোদালধোয়া গ্রামে তাদের ঘাঁটি স্থানান্তর করে।

১৬ জন মুক্তিযোদ্ধার অন্য একটি দল কুমিল্লার বুড়িচং থানায় আক্রমণ চালায়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও আট; ইত্তেফাক, ১৫ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১৫ ও ১৬ জুন ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান