বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত প্রতিরোধযোদ্ধা দলের অধিনায়কেরা ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুরের মুক্তাঞ্চল তেলিয়াপাড়ায় সমবেত হন। সেখানে তাঁরা একটি বৈঠক করেন। বৈঠকটি হয় তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের ডাকবাংলোতে।

কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী (স্বাধীনতার পর জেনারেল, সাংসদ ও মন্ত্রী) বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। অংশ নেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ (পরে বীর উত্তম, মেজর জেনারেল, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রদূত ও সাংসদ), মেজর খালেদ মোশাররফ (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল), মেজর নুরুল ইসলাম (পরে মেজর জেনারেল), মেজর শাফায়াত জামিল (পরে বীর বিক্রম ও কর্নেল), মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (পরে বীর বিক্রম ও মেজর জেনারেল) এবং ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন (পরে বীর প্রতীক ও মেজর জেনারেল) প্রমুখ। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা এবং মেজর কাজী নুরুজ্জামান (পরে বীর উত্তম ও কর্নেল)।

চট্টগ্রামে ইপিআর সদস্যদের নিয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে বীর উত্তম, মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশে ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে যাওয়ার কারণে তেলিয়াপাড়ার বৈঠকের খবর পাননি।

বৈঠকে উপস্থিত বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধরত বাঙালি সেনাদের অভিন্ন নির্দেশের আওতায় এনে পুনর্বিন্যাস করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, কিছু কিছু এলাকায় থাকা অতিরিক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে এনে যুদ্ধ–আক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী আরও সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিবাহিনীর দুটি দল অস্ত্রশস্ত্রসহ আখাউড়া থেকে ভারতের ভেতর দিয়ে দ্রুত চট্টগ্রাম এলাকায় যাবে। একটি দল যোগ দেবে মেজর জিয়াউর রহমানের (পরে বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে, অন্যটি ভাটিয়ারী এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করবে।

১০ এপ্রিল আবারও একটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

টিক্কা খানের সঙ্গে ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ

ঢাকায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম, খাজা খয়েরউদ্দিনসহ কয়েকজন। তাঁরা টিক্কা খানকে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেনাবাহিনীর তদারকিতে তাঁরা একটি নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন।

পাকিস্তানিদের হাতে চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ

দিনটিতে চট্টগ্রাম শহরের পুরো নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে থাকা বাঙালি ইপিআর সেনারা কোনো কমান্ড ছাড়াই দিনকয়েক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল। সীমিত রসদ শেষ হয়ে আসায় তারা নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানে অভিযান শুরু করে। শহরের উত্তর–পশ্চিম দিক দিয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক ধরে একটি দল, উত্তরে চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়ক ধরে দ্বিতীয় দল এবং চট্টগ্রামে কালুরঘাট ও কক্সবাজার সড়ক হয়ে শেষ দলটি শহর থেকে বেরিয়ে কালুরঘাটের দিকে যেতে থাকে।

বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ

বিবিসির খবরে বলা হয়, পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশবাণীর বরাতে বলা হয়, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামসহ আরও পাঁচটি বেসামরিক এলাকায় নাপাম বোমা ফেলেছে।

নিউইয়র্ক টাইমস–এ বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লি থেকে পাঠানো খবরের শিরোনাম ছিল, ‘এসবই খেলার রীতি: তবে ভয়ংকর ও নির্দয় এক খেলা’। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দ্য বাল্টিমোর সান–এ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘দ্বন্দ্বের মূল’ শিরোনামে ওয়াশিংটন পোস্ট–এ সেলিং এস হ্যারিসনের প্রতিবেদন বের হয়। দ্য বাল্টিমোর সান–এ জন ই উডরাফের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তানিরা বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করছে’।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, খণ্ড ১৪; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১ ও ৩; বিদেশির চোখে ১৯৭১, আন্দালিব রাশদী, (নালন্দা)


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান