যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালে ভারতীয় ছাত্র সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, পাকিস্তানি সামরিক চক্র পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চাইলেও সেখানকার সাধারণ মানুষ গেরিলাদের পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে। স্বাধীনতার স্পৃহাকে হত্যা করা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য তাঁর দেশ যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। প্রায় ৭০ মিনিট আলাপের মধ্য দিয়ে তাঁদের দুই দিনের আলোচনা শেষ হয়।
ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গেও আলোচনা করেন। নিক্সন ও রজার্স—দুজনকেই তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য সূত্রেই রাজনৈতিক সমাধান পেতে হবে।
সুইডেনের ৩৬০ জন সাংসদের মধ্যে ২৮০ জন এ দিন বাংলাদেশের সংকটমোচনে প্রভাব খাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানান। তাঁদের আবেদনপত্র স্টকহোমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে দেওয়া হয়।
ভারতের স্বীকৃতি শিগগিরই
মুজিবনগরে সরকারি একটি সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, ভারত সরকার শিগগিরই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে। সরকারি মুখপাত্র বলেন, একটি সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে তিনটি দিক বিবেচনা করা হয়—নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনগণ ও সরকার—তার তিনটিই বাংলাদেশের আছে। উপরন্তু এ সরকার গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত। তাঁরা আভাস পেয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিদেশ সফর শেষে ফেরার পর এ ব্যাপারে সরকারি ঘোষণা হতে পারে।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, গেরিলারা ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছেন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গেরিলাদের হাতে পাকিস্তানি সেনা হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সালদা নদীতীরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করেন। সেনা ও রাজাকারদের সমন্বিত এ দলটি কাছে আসতেই তাঁরা আক্রমণ চালান। অতর্কিত এ আক্রমণে কয়েকজন হতাহত হয়।
এই সেক্টরের ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা নটর ডেম কলেজের পাশে বোমা ফাটান। এতে কলেজসংলগ্ন সেতু এবং বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গেরিলাদের আরেকটি দল নারায়ণগঞ্জের কাছে হামলা করলে শান্তি কমিটির দুজন সদস্য নিহত হয়। অন্য আরেকটি দল চকবাজারে আক্রমণ চালায়। এতে একজন নিহত ও দুজন আহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ধর্মদহে রাজাকারদের ঘিরে ফেললে তারা কিছুক্ষণ প্রতিরোধ করে। একপর্যায়ে চারজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
এই সেক্টরের অন্য এক দল মুক্তিযোদ্ধা দেবীনগরে রাজাকারদের অবস্থানে অতর্কিতে হামলা করলে দুজন নিহত হয়।
বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য
পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত মর্নিং নিউজ পত্রিকার সাবেক সহযোগী সম্পাদক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিশ্ব রাষ্ট্রগোষ্ঠী স্বীকার করুক বা না করুক, বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সব রাষ্ট্রের তা স্বীকার করে নেওয়া উচিত।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় কলকাতায় এক আলোচনা সভায় বলেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তিনি সফল না হলে শরণার্থীদের নিরাপদে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে ভারতকে উদ্যোগী হতে হবে।
আদি কংগ্রেস বলেছে, ভারত সরকার অবিলম্বে বাংলাদেশ ও এর সরকারকে স্বীকৃতি দিক। কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সভাপতি সাদিক আলী এ দাবি জানান।
পাকিস্তানের তৎপরতা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ৫ নভেম্বর হঠাৎ চীনে যায়। সেখানে তারা চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে।
ইসলামাবাদে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত উপমহাদেশে শান্তি রক্ষায় উৎসাহী। পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি তাঁর সমর্থন আছে। এ কথা তাঁরা পাকিস্তানকে জানিয়েছেন।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট; ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, ৫ নভেম্বর ১৯৭১; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৬ নভেম্বর ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৬ ও ৭ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান