বিজ্ঞাপন
default-image

আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল ১১ জুন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইস মারিয়া দে পাবলো পার্দোর সঙ্গে দেখা করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তারা ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য জরুরি সাহায্য পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে যাঁরা সই করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, প্রখ্যাত গল্পকার হোর্হে লুইস বোর্হেস এবং ফাদার ইসমাইল কুলিস। আর্জেন্টিনার জাতীয় পত্রিকায় স্মারকলিপির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ১২ জুন প্রকাশিত হয়।

যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় ১১ জুন পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে বিতর্ক হয়। বিরোধী লেবার পার্টির সদস্য পিটার শোর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমালোচনা করে বলেন, রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যে পাকিস্তান ব্রিটেনের বন্ধুত্ব আশা করতে পারে না। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের সাহায্য যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করতে পারে না পাকিস্তান।

যুক্তরাজ্যের অধিবাসীরা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য এই দিন ৫৮ লাখ ৪০ হাজার ভারতীয় রুপির সমপরিমাণ অর্থ সাহায্য দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের রেডক্রস সোসাইটি শরণার্থীদের জন্য অবিলম্বে চিকিৎসাসামগ্রী, কলেরা ও টাইফয়েডের টিকা, খাদ্য ও তাঁবু পাঠানোর ঘোষণা দেয়। বেলজিয়াম সরকার শরণার্থীদের জন্য ২০ মিলিয়ন বেলজিয়াম ফ্রাঙ্ক এবং কানাডার কানাডিয়ান ক্যাথলিক কনফারেন্স ও কানাডিয়ান ক্যাথলিক অর্গানাইজেশন অ্যান্ড পিস শরণার্থীদের জন্য ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলার সাহায্যের ঘোষণা দেয়।

আরও সমর্থন, আরও দাবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দিন আসামে শরণার্থীশিবির পরিদর্শনকালে বলেন, শরণার্থীদের অনুকূলে বিশ্বে জনমত গড়ে উঠেছে। পৃথিবীজুড়ে পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারের কাহিনি প্রচারিত। পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে, তা শুধু পাকিস্তানের ব্যাপার নয়। ভারত সরকার ব্যাপারটি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখছে।

বাংলাদেশের ঘটনাবলি ও শরণার্থী সমস্যা বিশ্বনেতাদের জানাতে বিভিন্ন দেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এই দিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদুর সঙ্গে দেখা করেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর দেশটি এই দিন সরকারি ইশতেহার প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ভারত একা শরণার্থী সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। ভারত উপমহাদেশে শান্তি ও স্থায়িত্ব অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে জার্মানি তার আগ্রহের কথাও জানায়। ইশতেহারে বলা হয়, পরিস্থিতির দিকে তাঁরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ রাখছেন এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তার পক্ষে যে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সে সম্পর্কেও তাঁরা সচেতন।

ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এদিন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমাহানের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের ঘটনাবলি ও শরণার্থীদের বিষয়ে অবহিত করেন। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ভূমিকা রাখতে তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়নমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পিয়েত দে জংয়ের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং এ নিয়ে ভারতের মনোভাব তাঁকে জানান।

লন্ডনের উইক এন্ড টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর বক্তব্য পেশ করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বভ্রমণরত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ নিউইয়র্কে এক সভায় বলেন, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল অশান্ত হয়ে পড়বে। বক্তব্যের শুরুতে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ, শরণার্থীদের ভারতে আগমনের কথা বর্ণনা করেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের আবেদন

বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবদুস সামাদ আজাদ ১১ জুন দিল্লি থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে একটি আবেদন পাঠান। সে আবেদনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য পেশ করতে দেওয়া হোক। কারণ, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সামরিক সরকার বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করছেন এবং ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গণহত্যা বন্ধে বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করতে পাকিস্তানের ওপর অবরোধ আরোপের জন্যও বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছে তিনি আবেদন জানান।

বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুক্তাঞ্চলে চার দিনব্যাপী সফরের পর এই দিন মুজিবনগরে ফিরে আসেন। মনসুর আলী জানান, শিবিরসমূহে তিনি তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অদম্য মনোবল ও অনমনীয় দৃঢ়তা প্রত্যক্ষ করেছেন।

মুক্তিবাহিনীর অপারেশন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার উত্তরে চানলায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনারা ইয়াকুবপুরের দিকে পালানোর পথে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণের মুখে পড়ে। দুই অভিযানে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষয়ক্ষতি এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।

কুমিল্লার লাকসামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গাড়িতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, সিলেটের এনায়েতপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় ও নোয়াখালীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গুলিবিনিময় হয়।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও এগারো; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; ইত্তেফাক, ১২ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১২ ও ১৩ জুন ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান