বিজ্ঞাপন
default-image

অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৫০০ শিক্ষাবিদ, সাংসদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও ধর্মীয় নেতা ১১ সেপ্টেম্বর এক আবেদনে দেশটির সরকারকে অবিলম্বে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের অর্থসাহায্য বাড়িয়ে ৫০ লাখ ডলার করার অনুরোধ করেন তাঁরা। স্বাক্ষরকারীরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ বক্তব্য প্রচার করেন। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য উদ্যোগ নিতে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে আহ্বান জানান।

অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্টজনেরা তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন, পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা এবং টানা অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সেনা সরিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাকিস্তানকে উৎসাহ দিতে তাঁরা অস্ট্রেলিয়া সরকারকে অনুরোধ জানান।

অনুরোধ প্রত্যাখ্যান বেগম মুজিবের

বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত খবরে এ দিন বলা হয়, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন চায়, শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁদের ধানমন্ডির বাড়িতে বসবাস করুন। কিন্তু বেগম মুজিব এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাদের জানিয়েছেন, পাকিস্তানি লুটেরারা বাড়িটির যেসব আসবাব নষ্ট বা লুট করেছে, তার হিসাব তিনি আগে চান।

ওই বাড়িটির কিছু দূরে আরেকটি বাড়িতে বেগম মুজিবকে সপরিবার থাকতে দেওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ জন সেনা দিনরাত বাড়িটির পাহারায় নিয়োজিত ছিল। বাড়িটির ফটক এবং বাড়িটি যে রাস্তায়, তার দুই মুখই বন্ধ করে রাখা হয়। বেগম মুজিবের দুই ছেলে ভারতে। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা, ছোট ছেলে রাসেল এবং জামাই ও নাতি তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

ভারত-শ্রীলঙ্কা একমত

বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার সমাধান যে অত্যন্ত জরুরি, সে ব্যাপারে ভারত ও শ্রীলঙ্কা একমত হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের তিন দিনের শ্রীলঙ্কা সফর শেষে এ দিন প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আসায় ভারতে উদ্ভূত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয়টি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক লক্ষ করেছেন। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা মনে করে, পাকিস্তান রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে চললে শরণার্থীদের ফেরার সুযোগ হতে পারে।

ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে তিনি মনে করেন না। ৮৫ লাখ লোক যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তাকে তখন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলা চলে না। তাঁর ধারণা, যত দিন পূর্ব বাংলার মানুষ স্বশাসনের অধিকার না পাচ্ছেন, তত দিন তাঁরা দেশে ফিরে যেতে ভরসা পাবেন না।

ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকও এ দিন সল্টলেকে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। জিগমে ওয়াংচুক কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই শরণার্থীশিবির পরিদর্শনে গেলে সরকারি মহলে কিছুটা বিস্ময় দেখা দেয়।

ক্ষমতা চাইলেন ভুট্টো

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এ দিন বলেন, মার্চ মাসের যে ঘটনাবলি পূর্ব পাকিস্তানকে নাড়া দিয়েছিল, জাতির প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পশ্চিম পাকিস্তানেও সে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তিনি বলেন, পূর্ণ রাজনৈতিক ও বাক্‌স্বাধীনতাই সমাধানের একমাত্র পথ।

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের একজন মুখপাত্র এ দিন স্বীকার করেন, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পথে পথে মাইন পুঁতে রাখছে। তারা রাজাকার ও অন্য আধা সামরিক বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাচ্ছে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এ দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার কাছে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। এতে ট্রেনের চালকসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল কসবার বগাবাড়ির কাছে অ্যামবুশ করলে সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সেক্টরের অধীন মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল ফেনীর পরশুরামের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

অন্য একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার কামানদি চরে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। কেউ কেউ ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলারা ক্যাম্পে আটকে রাখা কয়েকজন নারীকে উদ্ধার করে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‍্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন; পূর্বদেশ, ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান